২৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পরিসংখ্যান দিবস : পরিকল্পিত অর্থনীতির জন্য চাই সঠিক পরিসংখ্যান

শনিবার ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ২০:২৮


পরিসংখ্যান!
 
এটি উপাত্ত সংগ্রহ, বিশ্লেষণ, পরিবেশন ও ব্যাখ্যা করার এক বিজ্ঞান। পরিসংখ্যানের অপর নাম রাশিবিজ্ঞান, ইংরেজি ভাষায় যাকে বলে স্ট্যাটিস্টিক্স। এটি এক ধরনের গাণিতিক বিজ্ঞান, যা মূলত উপাত্ত সংগ্রহ, বিশ্লেষণ, ব্যাখ্যা ও উপাত্ত সহজে পরিবেশন নিয়ে কাজ করে। বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান, মানবিক এবং আরো নানা শাখায় পরিসংখ্যানের ব্যবহার রয়েছে। তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তা থেকে তথ্যসমৃদ্ধ সিদ্ধান্ত গ্রহণে পরিসংখ্যানের ভূমিকা অপরিহার্য। যে কোনো ধরনের গবেষণার জন্য পরিসংখ্যান এর মৌলিক জ্ঞান থাকা আবশ্যক। তবে জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে পরিসংখ্যানের অপব্যবহারও হয়ে থাকে। বাংলায় ইংরেজি স্ট্যাটিস্টিক্স শব্দের প্রধানত দুইটি পরিভাষা রয়েছে। যারা পরিসংখ্যানের চর্চা করেন তাদেরকে সাধারণভাবে পরিসংখ্যানবিদ বলা হয়। পরিসংখ্যানের সমস্যা গুলো সাধারণত কোন নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা সমষ্টি নিয়ে আবর্তিত হয়। তথ্যের প্রাপ্যতা বা ব্যবস্থাপনা যোগ্যতার ওপর ভিত্তি করে সেই সমষ্টির প্রত্যেককে নিয়ে অথবা তার একটা অংশকে নিয়ে কোন চয়ন পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করা হয়। ভারতে পরিসংখ্যানের জনক বলে খ্যাত প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিশ। অন্যদিকে বাংলাদেশে পরিসংখ্যানের জনক কাজী মোতাহার হোসেন। ২০১০ সালে প্রকাশিত তালিকায় আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান সংস্থা ‘পরিসংখ্যান’ শব্দটিকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
 
জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের লক্ষ্যে ২০১৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে ‘পরিসংখ্যান আইন, ২০১৩’ পাস হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের ২৬ আগস্ট চারটি পরিসংখ্যান সংস্থাকে (পরিকল্পনা কমিশনের অধীন পরিসংখ্যান ব্যুরো, কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন কৃষি পরিসংখ্যান ব্যুরো ও কৃষি শুমারি কমিশন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন আদমশুমারি কমিশন) একীভূত করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর অনেকটা পথ পেরিয়ে আজ শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে দেশের পরিসংখ্যান ব্যবস্থা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সার্বিক কর্মকাণ্ড সমন্বয়, তত্ত্বাবধান ও সাচিবিক সহযোগিতা প্রদানের জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ৩ জুলাই পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিসংখ্যান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক ২০১২ সালে বিস্তৃত পরিসরে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৯ সালের ২৫ অক্টোবর আগারগাঁওস্থ সুদৃশ্য ও সুপরিকল্পিত পরিসংখ্যান ভবন উদ্বোধন করেন।
 
২০২০ সালের ৮ জুন মন্ত্রী পরিষদের বৈঠকে প্রতিবছর ২৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয়ভাবে পরিসংখ্যান দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় সংসদে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে পরিসংখ্যান আইন পাস করা হয়। এ আইনের ভিত্তিতে পরিসংখ্যান ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে আমূল পরিবর্তন আসে। এ দিবসটির স্মরণেই ২৭ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় পরিসংখ্যান দিবস হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) যৌথভাবে ‘জাতীয় পরিসংখ্যান দিবস’ পালন করে আসছে। দ্বিতীয়বারের মতো এবার জাতীয় পরিসংখ্যান দিবস পালিত হবে।
 
পরিকল্পিত অর্থনীতির জন্য সঠিক পরিসংখ্যান অপরিহার্য। আর এ কারণে দিন দিন বাড়ছে পরিসংখ্যানের গুরুত্ব। সে গুরুত্বকে প্রাধান্য দিয়ে দেশে জাতীয় পরিসংখ্যান দিবস পালিত হয়ে আসছে। এর আগে বাংলাদেশে ২০১০ সাল থেকে অন্যান্য দেশের সঙ্গে ২০ অক্টোবর বিশ্ব পরিসংখ্যান দিবস পালিত হয়ে আসছিল। এসডিজির ২৩১টি সূচকের মধ্যে ১০৫টির উপাত্তই দেবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ ৪টি সূচকের উপাত্ত দেবে, অর্থাৎ পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ২৩১টি সূচকের মধ্যে মোট ১০৯টি সূচকের উপাত্ত দেবে। এসডিজি পরিবীক্ষণে ডেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হালনাগাদ তথ্য প্রস্তুতে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের নেতৃত্বে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো কাজ করছে। দেশের পরিসংখ্যান ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়নের লক্ষ্যে ২০১৩ সালে পরিসংখ্যান উন্নয়নে জাতীয় কৌশলপত্র অনুমোদন করা হয়। এটি পরিসংখ্যানব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রণীত একটি বিস্তারিত, বাস্তবসম্মত, অংশগ্রহণমূলক, পরিবর্তনশীল ও রাষ্ট্রীয় স্বত্বাধীন পরিকল্পনা দলিল। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বহির্বিশ্বের সঙ্গে মানসম্মত তথ্যের আদান-প্রদান নিশ্চিত করে উন্নয়ন ও অগ্রগতির লক্ষ্যে জাতিসংঘ-ঘোষিত ‘বিশ্ব পরিসংখ্যান দিবস’ পালিত হয়ে আসছে।
 
দেশকে উন্নয়নশীল থেকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করতে প্রতিটি সেক্টরে নির্ভুল ও সময়ানুগ পরিসংখ্যানের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। দেশের সকল খাতে পরিসংখ্যানের প্রয়োগ বৃদ্ধি পেলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি আরো ত্বরান্বিত হবে। সঠিক, নির্ভরযোগ্য এবং সময়োপযোগী পরিসংখ্যান টেকসই উন্নয়ন-পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভিত্তি হিসাবে কাজ করে। টেকসই উন্নয়ন-পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সঠিক, নির্ভরযোগ্য এবং সময়োপযোগী পরিসংখ্যান ভিত্তি হিসাবে কাজ করে এবং আমাদের পরিবর্তিত বিশ্বকে বুঝতে সাহায্য করে। পরিসংখ্যানের গুরুত্ব সব সময়ই ছিল। কিন্তু এখন আরও অনেক বেড়েছে। কারণ দেশের অর্থনীতির পালস বুঝতে হলে পরিসংখ্যানের বিকল্প নেই। তাছাড়া জাতির উন্নয়ন আর অগ্রগতি যা-ই বলেন, সবকিছুর সঙ্গেই পরিসংখ্যান জড়িত। মানুষের সুষম উন্নয়নের জন্যও পরিকল্পনার প্রয়োজন। এখন বিশ্বব্যাপী পরিসংখ্যানের দিক বিবেচনা করেই উন্নয়ন পরিকল্পনা হাতে নেয়া প্রয়োজন।
 
সব খাতে পরিসংখ্যানের প্রয়োগ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করতে সহায়ক হবে। পরিসংখ্যান উন্নয়ন ও অগ্রগতির পরিমাপক। আর্থ সামাজিক সকল কর্মকান্ডের গতি-প্রকৃতি নির্ণয় ও উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নে পরিসংখ্যানের গুরুত্ব অপরিসীম। মূলত সঠিক পরিসংখ্যানই কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়নের পূর্বশর্ত। অর্থনৈতিক, জনমিতিক, সামাজিক সকল ক্ষেত্রে পরিমাণগত ও গুণগত পরিমাপে পরিসংখ্যানের ব্যাপক ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। বর্তমান বিশ্বে সরকারি ও বেসরকারি পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ, বাস্তবায়ন ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে পরিসংখ্যানের গুরুত্ব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেকোনো দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে সঠিক ও সময়োচিত পরিসংখ্যানের ব্যবহার অপরিহার্য। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রতিটি সেক্টরে নির্ভুল ও সময়ানুগ পরিসংখ্যানের প্রয়োগ দেশকে দ্রুত উন্নয়নশীল থেকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারে।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশগুলোর প্রকৃত উন্নয়ন চিত্র তুলে ধরতে পরিসংখ্যানের বিকল্প নেই। সরকার পরিসংখ্যান কার্যক্রমকে আধুনিকায়ন করে তা জাতীয় উন্নয়নে ব্যবহারের বিষয়ে অত্যন্ত আন্তরিক।
 
জাতীয় পরিসংখ্যান দিবস পালনের মধ্য দিয়ে দেশের সকল খাতে পরিসংখ্যানের প্রয়োগ বৃদ্ধি পাবে, যা অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করতে সহায়ক হবে। করোনাভাইরাসের মহামারি থেকে জীবন বাঁচাতে এবং এর থেকে উত্তরণে পরিসংখ্যানের গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সঠিক, নির্ভরযোগ্য, সময়োপযোগী এবং বিশ্বস্ত পরিসংখ্যান ভিত্তি হিসেবে কাজ করে এবং আমাদের পরিবর্তিত বিশ্বকে বুঝতে সাহায্য করে। দেশের উন্নয়নের জন্য অন্যতম প্রধান শর্ত হলো সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা। সঠিক পরিকল্পনার জন্য প্রয়োজন সময়োপযোগী সঠিক পরিসংখ্যান। পরিসংখ্যান যত নির্ভুল হবে, নীতি-নির্ধারকদের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ তত সহজতর হবে। সরকারকে সকল ক্ষেত্রে তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয়, সময়োপযোগী এবং মানসম্পন্ন পরিসংখ্যান সংগ্রহ ও প্রকাশ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে। তথ্য-উপাত্ত প্রক্রিয়া ও পরিজ্ঞাত করণে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে চাহিদা মাফিক উপাত্ত সরবরাহ এবং পরিসংখ্যান বিষয়ক কার্যক্রম সময়োপযোগী ও ত্বরান্বিত করণে সরকার সর্বদা সচেষ্ট হতে হবে।
 
পরিকল্পনাকারী, নীতি নির্ধারক, শিক্ষাবিদ এবং গবেষকগণ যারা দেশের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন, তাদেরকে বিদ্যমান পরিসংখ্যানের সর্বোত্তম ব্যবহারের জন্য জাতীয় পরিসংখ্যান দিবস পালনের মাধ্যমে দেশবাসীকে পরিসংখ্যানের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করার এ একটি অনন্য সুযোগ। দিবসটি পালনের মধ্য দিয়ে পরিসংখ্যানের ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও ব্যবহারের গুরুত্বকে সামনে নিয়ে আসবে। সময়োপযোগী সঠিক পরিসংখ্যানের সাহায্যে যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করে ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে সক্ষম হওয়া যাবে।
 
 
মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ
শিক্ষার্থী, পরিসংখ্যান বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

এমএসি/আরএইচ