সিডরের ভয়াবহতার কালো রাত্রি আজ, ক্ষত কাটেনি ১৪ বছরেও

সোমবার ১৫ নভেম্বর ২০২১ ১৫:০২


:: শেখ নাদীর শাহ্, পাইকগাছা (খুলনা) প্রতিনিধি ::


আজ ১৫ নভেম্বর। ট্রপিক্যাল সাইক্লোন সিডর তান্ডবের কালো রাত্রির দিন আজ। ১৪ বছর আগে ২০০৭ সালের আজকের দিন রাতে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০ জেলার উপর দিয়ে ভয়াবহ তা-ব চালিয়েছিল প্রলয়ংকারী সিডর। বঙ্গোপসাগর থেকে প্রায় পৌনে ৩ শ’ কিলোমিটার বেগে উপকূলে আঁছড়ে পড়ে সিডর। আগাম সতর্কতায় প্রাক প্রস্তুতি থাকায় ভয়াবহতায় প্রাণহানি হ্রাস করা গেলেও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। সরকারি হিসেবে যা ১৬ হাজার কোটি বলে সেনা সমর্থিত তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারও স্বীকার করেছিল। সরকারি হিসেবে মৃতের সংখ্যা ৩ সহস্রাধিক বলা হলেও আরো সহস্রাধিক নিখোঁজের কথা জানিয়েছিল তখনকার প্রশাসন।


সিডর দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ৩০টি জেলায় কম বেশি আঘাত হানলেও প্রায় ২শ’ উপজেলার সাড়ে ১৭শ’ ইউনিয়ন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সরকারি হিসেবে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের সংখ্যা ১৭ লাখ ৭৩ হাজার বলা হলেও বাস্তবে তা ছিল ২০ লাখেরও বেশি। ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের সংখ্যাও ছিল প্রায় ১ কোটি। সরকারিভাবে ৩ হাজার ১৯৯ জনের মৃত্যু ও ১ হাজার ৭২৬ জন নিখোঁজের কথা বলা হলেও এ সংখ্যাও আরো অনেক বেশি ছিলো বলে সে সময় বিভিন্ন সাহায্য সংস্থা দাবি করে। পরে বেশিরভাগ নিখোঁজদের কোন সন্ধান না পাওয়ায় ধরে নেওয়া হয়, সিডরের জলোচ্ছ্বাস তাদের সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে বলে মনে করা হয়। দক্ষিণ উপকূলের প্রায় ৪ লাখ ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ও আরো প্রায় ১০ লাখ আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। একই সাথে প্রায় ২ লাখ হেক্টর জমির আমন ধান সম্পূর্ণ ও আরো ৫ লাখ হেক্টরের আংশিক ক্ষতি হয়। প্রায় ৫০ লাখ গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগির মৃত্যু ঘটে কালো রাতে।


এরপর পর্যায়ক্রমে আঘাত হানে বুলবুল, আইলা, মহাসেন, ফণী, আম্পানের মতো সুপার সাইক্লোন। সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের মৃদু আঁচ থেকে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সাতক্ষীরাসহ উপকূলের বিভিন্ন এলাকার ঘরবাড়ি, চিংড়ি ঘের, ফসলি জমি। তবে গত দেড় দশকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে ঘিরে দুর্যোগের ভয়াবহতা ক্রমশ বাড়লেও ষাটের দশকে নির্মিত উপকূলের জরাজীর্ণ বেড়িবাঁধগুলো সংষ্কার হচ্ছেনা। দূর্যোগ পরবর্তী ক্ষতিগ্রস্থ বেড়িবাঁধে স্থানীয়ভাবে স্বেচ্ছাশ্রমে সংষ্কার হলেও সেখানকার মানুষের জানমাল রক্ষায় দৃশ্যত কোনো কাজেই আসছে না। এতে করে উপকূলের দরিদ্র মানুষের জীবন আরও বিপন্ন করে তুলছে।

জানাগেছে, ষাটের দশকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ছয় জেলা খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, বরগুনা, পটুয়াখালী ও ভোলায় অন্তত ৪ হাজার ৯০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়। নির্মাণকালে এসব বাঁধগুলো ১৪ ফুট উঁচু ও ১৪ ফুট প্রস্থে নির্মাণ করা হয়। দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় ও সুষ্ঠু তদারকির অভাবে বাঁধের কোল ঘেঁষে চিংড়ি ঘের শুরু হওয়ায় বাতাসে পানির তোড়ে ক্রমশ বাঁধগুলো ক্ষয়ে সংকুচিত হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও চিহ্ন পর্যন্ত নেই। বিধায় দূর্বল বাঁধগুলো এখন আর ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নিম্নচাপ, লঘুচাপ, অমাবস্যা-পূর্ণিমার জোয়ারে গ্রামে পানি ঢোকা ঠেকাতে পারছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বলছে, এবার ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে উপকূলীয় নদীগুলোতে জোয়ারের উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে ৩ থেকে ৬ ফুট বেড়ে যায়। ফলে অনেক স্থানে বেড়িবাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি ঢুকে প্লাবিত হয়ে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। অসংখ্য স্থানে বাঁধ ভেঙ্গে লোকালয়ে লবণ পানি ঢুকে পড়ে।


পাউবোর খুলনার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল হোসেন জানান, সর্বশেষ ইয়াসের প্রভাবে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার প্রায় ৫০০ কিঃমিঃ বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাউবো বরিশাল অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশল সূত্র জানায়, বরিশাল বিভাগের বরগুনা, পটুয়াখালী ও ভোলা জেলার অন্তত ১২টি পয়েন্টে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে তিন জেলার শত শত গ্রাম পানিতে তলিয়ে যায়।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের প্রধান অধ্যাপক আবদুল্লাাহ হারুন চৌধুরী বলেন, উপকূলের অধিকাংশ এলাকার পানি লবনাক্ত। লবনাক্ত মাটির দিয়ে তৈরী মেয়াদোত্তীর্ণ বেড়িবাঁধের উচ্চতা ও প্রশস্ততা কমে যাওয়ায় সেগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। কেননা, লবণাক্ত পানি বাঁধের মাটির গাঁথুনি (বন্ডিং) দুর্বল করে ফেলে। এ ছাড়া অধিকাংশ বাঁধগুলো ছিদ্র করে চিংড়ি ঘেরে লবণ পানি তোলার ফলে ক্রমশ বাঁধগুলো দুর্বল হয়ে গেছে। উপকূলবিদ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশ্লেষকরা জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দুর্যোগের চরিত্র বা ধরনও বদলে গেছে। গত এক দশকে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সংখ্যা এবং দূর্যোগের ভয়াবহতাও বেড়েছে বহুগুণ। ফলে এসব দূর্যোগের শিকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে যেকোন সময়ের চেয়ে। এক কথায় বাঁধগুলো এখন আর ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত সামলাতে পারছে না। পুরনো বাঁধগুলো খুবই নাজুক ও দুর্বল হয়ে পড়েছে দুর্যোগের গতি-প্রকৃতি এবং ভয়াবহতা অনুধাবন করে উপকূলীয় জীবন ও সম্পদ রক্ষাকারী বাঁধগুলো আরো টেকসই ও মজবুত করে নির্মাণ করতে হবে বলেও মত দেন তারা।

পাউবোর বরিশাল আঞ্চলিক দপ্তর সূত্র জানায়, বরিশাল বিভাগের তিন হাজার ৩০০ কিলোমিটার বাঁধের মধ্যে মাত্র ৬৯ কিলোমিটার টেকসই উন্নয়ন হয়েছে। ৮২টি পোল্ডারের আওতায় ওই তিন হাজার ৩০০ কিলোমিটার বাঁধের সিডরে ১৮০ কিঃমিঃ সম্পূর্ণ এবং এক হাজার ৪ শ’ কিঃমিঃ আংশিক ক্ষতি হয়। এরপর আইলা ও মহাসেনের আঘাতে ৫২৭টি বাঁধের মধ্যে ৬৮ দশমিক ৮ কিঃমিঃ সম্পূর্ণ ও ৫ দশমিক ১৯ কিঃমিঃ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আম্পানে ১৬১ কিঃমিঃ বাঁধ পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

পাউবোর খুলনার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সূত্র জানায়, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার এক হাজার ৬৫০ কিঃমিঃ বাঁধের ১০ শতাংশ মোটামুটি ভালো। বাকি ৯০ শতাংশই জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ। এই ৯০ শতাংশ বাঁধের মধ্যে ১০ শতাংশ নামমাত্র টিকে আছে। তিনি বলেন, এ অবস্থায় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন করে ৪৮০ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণের জন্য সাতটি প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরও প্রকল্প গ্রহণ করা হবে। বরিশাল পাউবো জানায়, বিভাগের ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামতের জন্য ২০১০ সালে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সংস্কার কাজ শুরু হয়। পরে সেটি তহবিল সংকটের কারণে বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৪ সালে ওই কাজ ফের শুরু হয়। এখন বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এক হাজার ৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে কোস্টাল এমব্যাংকমেন্ট ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় বরগুনায় দুটি, পটুয়াখালীতে তিনটি এবং পিরোজপুর জেলায় একটিসহ ছয়টি পোল্ডারের বাঁধ উঁচুকরণের কাজ বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।

বরগুনার পাথরঘাটার উন্নয়ন সংগঠন সংকল্প ট্রাস্টের পরিচালক মির্জা সাইদুর রহমান খালেদ সাংবাদিকদের বলেন, যখনই দেশে বড় কোনো ঝড়ঝঞ্ঝা হয়, তখনই বাঁধের উচ্চতা বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা হয়। ঝড় থেমে গেলে আলোচনাও থেমে যায়। জেলার মাঝের চরের বাসিন্দারা বলেন, তারা প্রতি বছর পানিতে ভাসলেও তাদের রক্ষায় কার্যত কেউ এগিয়ে যায়না। বর্ষার মৌসুমে দিনে দু’বার জোয়ারে ডুবেন জানিয়ে সিডরে ৭৭ জন মানুষ মাঝেরচরে মরছে বলেও জানান তারা খুলনার কয়রা উপজেলার গোবরা গ্রামের হাফিজুর রহমান, আবুল বাশার ও ইয়াকুব শেখ বলেন, দুর্বল বেড়িবাঁধের কারণে বিভিন্ন সময় ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ ভেঙ্গে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে। এ ছাড়া নিম্নচাপ এবং অমাবস্যা-পূর্ণিমার জোয়ারে বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। এর ফলে উপকূলীয় খুলনার কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা ও বটিয়াঘাটা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি এবং বাগেরহাটের শরণখোলা ও মোংলার কয়েক লাখ মানুষ চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দিন ক্ষোভের সাথে বলেন, বিভিন্ন সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাঁধগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কখনোই এগুলো ভালোভাবে সংস্কার করা হয়নি। প্রতিবারই কাজ হয়েছে দায়সারাভাবে। ঠিকাদাররা বেড়িবাঁধ সংস্কারের টাকা লুটপাট করেছেন বলেও অভিযোগ তার।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) বরগুনা জেলা শাখার সদস্য সচিব মুশফিক আরিফ বলেন, ইয়াসের প্রভাবে যে পরিমাণ জলোচ্ছ্বাস হয়েছে তা সিডর, আইলা ও আম্পানে হয়নি। ইয়াস চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে, যে বাঁধ আছে কিন্তু তা কোনভাবেই দুর্যোগ প্রতিরোধ সহায়ক নয়। খুলনা-৬ (কয়রা-পাইকগাছা) আসনের সংসদ সদস্য শেখ মো. আকতারুজ্জামান বাবু বলেন, ৬০ বছর আগে তৈরি বেড়িবাঁধ দিয়ে উপকূলীয় এলাকা রক্ষা করা এখন আর সম্ভব নয়। এ জন্য তিনি নতুন করে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য একাধিকবার প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে চিঠি দিয়েছেন। জাতীয় সংসদে দাবি উত্থাপন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়েও চিঠি দিয়েছেন। তিনি বলেন, টেকসই বাঁধ নির্মাণের পাশাপাশি ড্রেজিং করে উপকূলীয় এলাকার নদীগুলোর গভীরতা বাড়ানো হবে বলেও সাংবাদিকদের জানান তিনি।

 

এমএসি/আরএইচ