শার্শায় এই নির্বাচনী সহিংসতায় নিহত ২, আহত প্রায় শতাধিক

বুধবার ২৪ নভেম্বর ২০২১ ১৬:৪৯


আগামী ২৮ নভেম্বর তৃতীয় ধাপের নির্বাচন কে কেন্দ্র করে যশোরের সিমান্তবর্তী শার্শা উপজেলার ৪ টি ইউনিয়নে প্রতিদিনই চলছে অতর্কিত ও পূর্ব পরিকল্পিত হামলা। সহিংসতার হতাহতের শীর্ষ তালিকায় অবস্থান করছে গোগা ইউনিয়ন, বাগআচড়া ইউনিয়ন, উলাসী ইউনিয়ন এবং ডিহি ইউনিয়ন। আর এই হামলায় রক্ত ঝরছে অনেকরই। গত ২৮ অক্টোবর থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত নির্বাচনী সহিংসতায় শার্শা উপজেলায় নিহত হয়েছে দুইজন। ও আহত প্রায় শতাধিক।

তবে গত ১২ নভেম্বর প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে এই নির্বাচনী সহিংসতা ও হতাহতের মাত্রা যেন ক্রমশ বেড়েই চলছে। আসন্ন নির্বাচনে নৌকার উপযুক্ত মাঝি না হওয়ায় আওয়ামী লীগের মধ্যে পক্ষ বিভক্ত কে এর কারন বলে মনে করছে ইউনিয়নের সাধারণ জনগন। আবার অন্যদিকে ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা বলছেন যারা নৌকার বিপক্ষে লড়ছেন তারা আওয়ামী লীগ করে না তারা আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী। তারা জামাত বিএনপির ছায়াতলে প্রকৃত আওয়ামী লীগের সুনাম কে হটাতে সতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিরোধিতা করছেন।

শার্শার ইউপি নির্বাচনে গত ২৩ অক্টোবর গোগা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রার্থী তবিবর রহমানের মনোনয়ন নিতে তার সমর্থকরা যশোর যান।

যশোর থেকে বাড়ী ফেরার পথে গোগা বাজারে রশিদ চেয়ার ম্যানের সন্ত্রাসী বাহিনী কর্তৃক তবিবর রহমান সমর্থিত ১২জন আহত হয়। আহত ১২ জনের মধ্যে ১১ নভেম্বর আলী ফকির। আলী ফকির শার্শা থানায় রশিদ চেয়ারম্যানের সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যদের নাম উল্লেখ করে শার্শা থানায় একটি মামলাও করেছিলেন।

এদিকে ১২ নভেম্বর উৎসবমুখর পরিবেশে শার্শা নির্বাচন অফিসে প্রতীক বরাদ্দ হয়। এরপর থেকেই শুরু হয় নির্বাচনী সহিংসতা ও অস্ত্রের মহড়া। প্রতীক বরাদ্দের পর শার্শা উপজেলার ডিহি ইউনিয়ন গত ১৬ নভেম্বর দুই ইউপি সদস্য খানজাহান আলী ও কামরুজ্জামান জজ মিয়ার কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষে উভয়পক্ষের ২২ জন কর্মী আহত হয়। জানা যায় এ দিন তালা প্রতীকের কামরুজ্জামান জজ মিয়ার সমার্থকরা নির্বাচনী কার্যলয়ে বসে মিটিং করছিলেন। এমন সময় প্রতিপক্ষ মোরগ প্রতীকের খানজাহান আলীর কর্মীরা অতর্কিত ভাবে রাম দা, সহ বিভিন্ন রকম ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। হামলার ঘটনায় ঘটনাস্থলেই ২২ জন রক্তাক্ত হলে তাদের শার্শা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সহ যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনায়ও উভয়পক্ষ শার্শা থানায় অভিযোগ করেছিলো।

একই দিনে অর্থাৎ গত ১৬ নভেম্বর শার্শার বাগআঁচড়ায় নির্বাচনী সহিংসতায় আনারস প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল খালেক ও নৌকার প্রার্থী ইলিয়াছ কবির বকুলের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এ সময় আনারস প্রতীকের সমর্থক মোস্তাক ধাবকসহ  উভয় গ্রুপের সাতজন আহত হন। আহত সবাইকে  বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মোস্তাক ধাবকের অবস্থার অবনতি হওয়ায় ১৭ নভেম্বর তাকে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।  গত ১৯ নভেম্বর দিবাগত রাত অর্থাৎ ২০ নভেম্বর ভোর ৪ টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মোস্তাকের মৃত্যু হয়। এ ঘটনার পর পর ওই এলাকায় সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ সৃষ্টি হয়। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে।

এ ঘটনার পরের দিনই গত ১৭ নভেম্বর বাগআঁচড়া ইউনিয়নে রাত ১১ টার দিকে সতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী আনারস প্রতীকের আব্দুল খালেকের কর্মীদের উপর ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায় একই ইউনিয়নের নৌকার মাঝী ইলিয়াস কবীর বকুলের লাঠিয়াল ও অস্ত্র বাহিনী। এ ঘটনায় আনারস প্রতীকের ৭ কর্মী রক্তাক্ত হয়ে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হয়। মিছিল চলাকালে দুই গ্রুপ মুখোমুখি হলে এ সংঘর্ষ হয়। এর পরের দিন আব্দুল খালেকের লোকজন বাগআচড়া সড়ক অবরোধ করে প্রায় ১ ঘন্টারও বেশি অবরোধ বিক্ষোভ চালায়।

ঠিক একই দিনে (১৭ নভেম্বর) দুপুর নাগাদ উপজেলার উলাশী বাজারে চেয়ারম্যান পদে নৌকা প্রার্থীর সমর্থকেরা সতন্ত্র প্রার্থী আনারস প্রতীকের নির্বাচনী অফিস ভাংচুর ও কর্মী সমর্থকদের সাথে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। একই সাথে সম্বন্ধকাঠি মোড়ের মেম্বর পদপ্রার্থী সাইফুল ইসলামের নির্বাচনী অফিসটিও ভাংচুর করে গুড়িয়ে নৌকার কর্মীরা। এ ঘটনায় সতন্ত্র প্রার্থী আলহাজ্ব আয়নাল হকের কর্মী নজরুল ইসলাম সহ ৭ কর্মী আহত হয়ে শার্শা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নেয়।

এদিকে অত্যাচার নির্যাতন চালানো নিয়ে বহু বিতর্কিত হয়ে উঠেছে উপজেলার উলাসী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদে সতন্ত্র প্রার্থী ও শার্শার গোটা উপজেলার কথিত ত্রাস আয়নাল হক। সংঘর্ষ বা অস্ত্রের মহড়া কম করলেও নিপীড়ন কম চালাচ্ছে না। তিনি নাকি হাতে না মারলেও ভাতে মারেন। নৌকার বৈঠা হাতছাড়া হওয়ায় গত ১৮ নভেম্বর দুপুর ১২টার দিকে শার্শার কন্যাদাহ মাদ্রাসায় পথসভা ছিল নৌকা প্রতীকের উলাশী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রার্থী রফিকুল ইসলামের। বর্তমান চেয়ারম্যান নৌকা প্রতীক না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে আনারস প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আয়নাল হক। তিনি বাজারে প্রকাশ্যে তার বাহিনী দিয়ে বোমা ও অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে দোকানপাট বন্ধ করে দেন। গ্রামের বাড়ির টিউবওয়েলের মাথা খুলে দেন যাতে নৌকা প্রতীকের সমর্থকরা পানি না খেতে পারেন। গ্রামের মহিলারা আয়নাল হকের ভয়ে ঘরে পালিয়ে থাকেন। ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পান না। আয়নাল হক যেন শার্শার কন্যাদাহ গ্রামের মানুষ রূপী এক ভয়ঙ্কর ব্যক্তি। এ অভিযোগ এলাকার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের।

সর্বশেষ গত ১৯ নভেম্বর শার্শা উপজেলার গোগা ইউনিয়নে সতন্ত্র প্রার্থী তবিবর রহমানের আনারস প্রতীকের ৩ কর্মী আশরাফুল,ফজের আলী,ও রবিউল কে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আব্দুর রশিদের কর্মী শাবুমদ্দি ও নেছার গুলি করে আহত করেছে। এতে দুইজন গুলিবিদ্ধ হয় ও একজন আহত হয়।

জানা যায়, এ ঘটনার আগের দিন রাতে নৌকার কর্মীরা আনারস প্রতীকের নির্বাচনী অফিস ভাংচুর করে। পরের দিন সকালে ইউনিয়নের পাঁচ ভুলট দাখিল মাদ্রাসা বল ফিল্ডে আনারস প্রতীকের কর্মীরা আগের রাতে ভাংচুর করা অফিস দেখতে গেলে হঠাৎ নৌকা প্রতীকের দুই কর্মী আনারস প্রতীকের প্রার্থী ও কর্মীদের লক্ষ করে বোমা ও গুলি ছোড়ে।  এসয়ম আনারস প্রতীকের ২ কর্মী গুলিবিদ্ধ হয় এবং কয়েকজন জখম হয়। পরে গুলিবিদ্ধ দুই জনকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করেন। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়াসে।

এছাড়াও প্রতীক বরাদ্দের আগ মুহুর্তে অর্থাৎ গত ৭ নভেম্বর উপজেলার বাগআঁচড়া ইউনিয়ন এর ৪নং ওয়ার্ডের সোনাতনকাটি বামুনিয়া বাজারে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নমিনেশন পাওয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গত ২ বারের চেয়ারম্যান ইলিয়াছ কবির বকুলের সমর্থকেরা নৌকার মিছিল করতে গেলে জামাত বিএনপি সমার্থিত কথিত আওয়ামী লীগ নেতা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদে সতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল খালেক, ও তার ভাই রনকুল, আব্দুস সাত্তার, ভাইপো শিপলু, সহ বিএনপি’র সাবেক কেন্দ্রীয় সহদপ্তর সম্পাদক মফিকুল হাসান তৃপ্তির চিহ্নিত বিএনপি ও জামাত কর্মীদের হামলায় নৌকার কর্মী আনোয়ার হোসেন, আব্বাস আলী, আব্দুল মজিদ, আলতাফ হোসেন, সহ ১৫ থেকে ২০ জন গুরুতর আহত হয়।

এরিমধ্য গতকাল (২০নভেম্বর) পুটখালী ইউনিয়নের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গোল্ড নাসির ওরফে গরু নাসির হিসাবে পরিচিত নাসির উদ্দিন অধিপত্য বিস্তার করার জন্য তার কর্মীদের দিয়ে মহিষডাঙা এলাকায় একটি বাশ বাগানে বোমা ও বিস্ফোরক দ্রব্য তৈরি করছিলো এমন সময় সংবাদ পেয়ে বেনাপোল পোর্ট থানা পুলিশ তাৎক্ষনিক ঘটনাস্থলে পৌছালে হাতে নাতে বোমা সহ আলী হোসেন মোড়লের পুত্র জাহিদ হাসান(২১), গোলাম হোসেন মোড়লের পুত্র আলা হোসেন(২৬), ও জমির মোড়লের পুত্র সজীব হোসেন(২৩)কে গ্রেফতার করে। আসামীরা সকলেই মহিষডাঙা গ্রামের বাসিন্দা।

শার্শা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল হক মঞ্জু সমাজের কথা কে বলেন, নির্বাচন কে সামনে রেখে শার্শা উপজেলায় এতো সহিংসতা কেন হচ্ছে এ ব্যাপারে আমরা এই মুহুর্তে কিছু বলতে পারছি না। নির্বাচনের পরে সবাই ভাই ভাই তাই আমরা সকলকেই বলি এবং বলে আসছি যে আপনারা কেউ সহিংসতার মধ্যে জড়াবেন না বা সহিংসতা করবেনও না। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমরা নৌকার কাজ করি এবং আমরা চাই যেন একটা সুষ্ঠু নির্বাচন হোক।

তবে অনান্য বারের তুলনায় এ বছর বেশি সহিংসতার ঘটনা ঘটছে যেটি আমদের কাম্য নয়। যারা আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করেছে এবং সহিংসতায় জড়িত তাদের নাম উল্লেখ করে আমরা আরও ৪-৫ দিন আগে বহিস্কারের সুপারিশ করে জেলায় পাঠিয়েছি। তবে এখন পর্যন্ত কোন ফিডব্যাক পাইনি। তবে আমি শার্শা থানায়ও বলেছি পুলিশের সজাগ দৃষ্টি দিতে। সহিংসতায় যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে বলেছি।

এ ব্যাপারে শার্শা থানার পুলিশ পরিদর্শক(তদন্ত) তারিকুল ইসলাম বলেন, শার্শার গোগা ইউনিয়নে নির্বাচনী সহিংসতায় নিহত আলী ফকির বেঁচে থাকা অবস্থায় মামলা করেছিলেন, সে মামলায় দুই জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তারা বর্তমানে জামিনে রয়েছে। এবং গত ১৯ নভেম্বরের গোগা ইউনিয়নে গোলাগুলি এবং বিস্ফোরণের ঘটনায় মামলা প্রক্রিয়াধীন। এ ছাড়া নির্বাচনী সহিংসতা যাতে আর না হয় সেজন্য পুলিশ তৎপর আছে।

নাভারন সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) জুয়েল ইমরান বলেন,২৮ তারিখ জনগণ যাতে নির্বিঘ্নে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে সেই ব্যবস্থা করা হবে।

 

এমএসি/আরএইচ