মহাখালীতে কাগজপত্র দেখার নামে পুলিশের বেপরোয়া চাঁদাবাজি

শনিবার ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ২০:২১


:: বনানী (ঢাকা) প্রতিনিধি ::
 
রাজধানীর মহাখালী আমতলী সিগন্যালে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের চাঁদাবাজির মহোৎসব চলছে। এ সিগন্যালে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের দায়িত্বরত টিআই ও সার্জেন্টগণ প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি করছেন। বাস ট্রাক ও কাভার্ডভ্যানসহ বিভিন্ন যানবাহনের কাগজপত্র দেখার নামে গাড়ি আটকের পর মামলার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করা হচ্ছে। আর এ চাঁদাবাজি দিনের চেয়ে রাতের বেলায় বেশি হচ্ছে। প্রতিদিন রাত ৮টার পর থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত বাস, ট্রাক, কাভার্ডভ্যানসহ মালামাল বহনকারী বিভিন্ন যানবাহন আটক করে প্রকাশ্যে চাঁদা আদায় করছেন। ব্যস্ততম এলাকার যানজট নিরসনের পরিবর্তে ট্রাফিক ও সার্জেন্টদের চাঁদাবাজির কারণে তা আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ। এছাড়া কাগজে-কলমে কোনো নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও এ সিগন্যাল দিয়ে কোনো বাস ইউটার্ন নিতে দেন না এখানে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশরা। আবার টাকা দিলে ইউটার্ন নিতে দেওয়া হয়। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বাস চালকরা।
 
আমতলী সিগন্যাল এলাকায় সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, প্রতিদিন রাত ৮টার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ট্রাফিক পুলিশ ও সার্জেন্টরা যত্রতত্র যানবাহন থামিয়ে কাগজপত্র দেখার নামে চাঁদা আদায় করছেন। শুধু তাই নয়, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, সিএনজি অটোরিকশা এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন নানা ব্রান্ডের গাড়ি কারণে-অকারণে থামিয়ে কাগজপত্র চেকসহ বিভিন্ন অজুহাতে হয়রানি করছে। আবার অনেক গাড়ি ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটক রাখায় যানজটেরও সৃষ্টি হচ্ছে। গাড়ির কাগজপত্র চেক করা নয়, সাধারণ মানুষকে হয়রানি আর টাকা আদায়ই তাদের মূল টার্গেট বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন। রাস্তায় লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা ফিটনেসবিহীন যাত্রীবাহী বাসসহ যানবাহনগুলো তাদের চোখে পড়ছে না। এসব ফিটনেসবিহীন যানবাহনের চালক ও মালিকদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা মাসোহারা নিচ্ছে ট্রাফিক পুলিশ। 
 
শনিবার (১২ ফেব্রুয়ারি) সকাল ৭টায় দেখা যায় বাস, ট্রাক ও পিকআপ থামিয়ে চাঁদা আদায় করছেন আমতলী ট্রাফিক পুলিশ বক্সের ট্রাফিক পুলিশ। গাড়ি থামানোর পর জানালা দিয়ে ট্রাফিক পুলিশের হাতে টাকা গুঁজে দিলেই ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। যারা তর্কে জড়াচ্ছে তাদের গাড়ির কাগজপত্র নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পুলিশ বক্সে। সেখানে টাকা দিয়ে আপোস করতে পারলে কাগজপত্র ফেরত দেওয়া হচ্ছে, নয়তো মামলা নিতে হচ্ছে।
 
সরেজমিনে আরও দেখা যায়, আমতলীতে ট্রাফিক পুলিশরা দৌড়ে, লাফিয়ে বাস-পিকআপের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে তা থামান রাস্তার মাঝে। বাসের স্টাফ নেমে হাতে ১০০ টাকা গুঁজে দিলেই ছেড়ে দেন। এছাড়া কোনো বাস ইউটার্ন নিতে চাইলেই দু'তিনজন ট্রাফিক পুলিশ ঘিরে ধরে। ইউটার্ন নিতে দেয় না। আবার টাকা গুঁজে দিলেই ইউটার্ন নিতে দেওয়া হয়।
 
আমতলী সিগন্যালের পশ্চিম পাশে ট্রাফিক পুলিশের চাঁদাবাজির শিকার একটি পিকআপের চালক জানান, প্রতিদিন ভোরে কারওয়ান বাজার থেকে কাঁচামাল নিয়ে গাজীপুর যান। যাওয়ার পথে আমতলীতে ট্রাফিক পুলিশের চাঁদাবাজিতে তারা অতিষ্ঠ। কারণে-অকারণে গাড়ি থামিয়ে মামলা দেয়ার ভয় দেখানো হয়। আর তাদের চাহিদা মতো টাকা দিলে সব ঝামেলা চুকে যায়।
 
অন্যদিকে আমতলী সিগন্যালের পূর্ব পাশে গুলশানগামী বাস থামিয়ে যাত্রী তোলার নির্ধারিত স্থান সাউথ পয়েন্ট স্কুলের গলি পেরিয়ে। অথচ মোড়েই বাস থামিয়ে যাত্রী উঠা-নামা করা হয়। এরজন্য আনসার সদস্য এবং লাইনম্যানরা প্রতি বাস থেকে ১০ টাকা করে চাঁদা নেয় (যতবার থামে ততবার)।
 
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মহাখালী রেলগেইট, ডিওএইচএস ও আমতলী পুলিশ বক্স ট্রাফিক পুলিশের এই চাঁদাবাজি নিত্যদিনের। যানজটের তোয়াক্কা না করে শুধু দিনে নয়, রাতভর চাঁদা নিতে তৎপর এসব ট্রাফিক সদস্যরা। কোনো গাড়ি ইউটার্ন নিতে গেলে লাফিয়ে পড়েন গাড়ির সামনে। যদিও এখানে ইউটার্ন নিষেধ এমন কিছু উল্লেখ নেই।
 
সূত্র জানায়, বাংলাদেশে পণ্যবাহী ট্রাক থেকে প্রতিদিন গড়ে এক কোটি টাকা চাঁদা আদায় করে পুলিশ। বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিকরা জানান, সাংবাদিকদের এ বিষয়ে জানালে আরো অধিক হয়রানির শিকার হতে হয়। এর প্রতিবাদ করলে চাঁদার হার পুলিশ আরো বাড়িয়ে দেয়। দেশে প্রতিদিন ৯০ হাজার পণ্যবাহী ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান চলাচল করে। এর কোনোটিই পুলিশকে চাঁদা না দিয়ে চলতে পারে না। বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির কর্মকর্তারা জানান, সড়ক বা মহাসড়কে এই ট্রাক চলাচল করতে গিয়ে একেকটি স্পটে ৫০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। এই চাঁদা যেমন হাইওয়ে পুলিশ নেয়, তেমনি ট্রাফিক পুলিশও আদায় করছে। একশ্রেণির পরিবহন শ্রমিক, চিহ্নিত সন্ত্রাসী, পুলিশ ও ক্ষমতাসীন মহলের আশীর্বাদপুষ্টদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে সম্মিলিত চাঁদাবাজ চক্র। তাদের কাছেই জিম্মি হয়ে পড়েছে যানবাহন চালক, মালিকসহ সংশ্লিষ্ট সবাই। শুধু তাই নয়, ট্রাফিক পুলিশের টোকেন বাণিজ্যও থেমে নেই। তবে প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস এবং নামিদামি ব্র্যান্ডের জন্য পুলিশের মাসিক টোকেন সংগ্রহ না করায় প্রতিদিনই তাদের নানা হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। কাগজপত্র দেখার নাম করে এসব গাড়ি ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটক করে রাখে, তারপর টাকার বিনিময়ে রফাদফা হলেই পুলিশ তা ছেড়ে দিচ্ছে।
 
ডিএমপির এক সূত্রে জানা গেছে, সড়কসমূহে চাঁদাবাজি রোধে পুলিশের পক্ষ থেকে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। আর চাঁদাবাজির স্থান হিসেবে শতাধিক পয়েন্টকে চিহ্নিত করে সেখানে সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নজরদারি করছেন। এছাড়া সিসি ক্যামেরা ফুটেজের ভিত্তিতে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কতিপয় সার্জেন্ট, ট্রাফিক ও পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।
 

এমএসি/আরএইচ