"সঠিক কাজটি সঠিকভাবে করা" - পঞ্চম (শেষ) কিস্তি

"ব্যবস্থাপক যাহা করেন তাহাই ব্যবস্থাপনা' -৫/৫

বুধবার ১ জুন ২০২২ ১৭:৪৭


অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান

McKinsey 7-S ফ্রেমওয়ার্কের শেষ তিনটি সফটওয়্যার উপাদান হচ্ছে-  স্টাফ, স্কিল, এবং স্টাইল(staff, skill, style) । লক্ষ্য অর্জনের জন্য কৌশল প্রয়োগ করতে গেলে এর একটি বিস্তারিত কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হয় । কৌশল এর বিস্তারিত রূপ হচ্ছে প্রোগ্রাম (program is the detailed version of strategy) । কৌশল প্রয়োগ করতে গেলে কি কি কাজ করতে হবে, কে কাজটি কখন কিভাবে করবে, তার বিস্তারিত বিবরণ প্রোগ্রামে থাকে । 

লক্ষ্য অর্জনের জন্য করনীয় কাজগুলো নির্দিষ্ট করার পরই ঠিক করতে হবে, এ কাজ কে করবে । যে পরিমাণ জনবল প্রয়োজন সেই পরিমান জনবল যথাযথ ভাবে নিয়োগ করাকেই বলা হয় স্টাফিং । স্টাফ এর বাংলা আভিধানিক অর্থ হচ্ছে- কাজের লাঠি, দন্ড, ছড়ি, বা হাতিয়ার অর্থাৎ স্টাফিং হচ্ছে প্রয়োজনীয় জনবল ।

ব্যবস্থাপনার কাজ দক্ষতার সাথে সম্পাদনের জন্য স্টাফিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।  যথাযথ জনবল না থাকলে ব্যবস্থাপনা কোন কাজেই ভালোভাবে সম্পাদন করতে পারবে না । প্রযুক্তি বদলের  সাথে সাথে সাথে নতুন প্রযুক্তির সাথে খাপ খাওয়াতে হলে দক্ষ প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন জনবল দরকার ।  সর্বশেষ প্রযুক্তির যথাযথ জ্ঞানসম্পন্ন জনবল না থাকলে প্রযুক্তি ব্যবহাররে সংগঠন পিছিয়ে পড়ে প্রতিযোগিতায়ও পিছিয়ে পড়বে ।  

একটি সংগঠনে যথাযথ স্টাফিং হলে  দক্ষতার সাথে কার্য সম্পাদন করা যায়, প্রযুক্তি ও অন্যান্য সম্পদের ব্যবহার সর্বোচ্চকরণ সম্ভব হয় । মানব সম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে কোম্পানির রিসোর্স বাড়ানো যায় । একটি অনুপ্রাণিত দক্ষ মানব সম্পদ একটি কোম্পানির অন্য যে কোন সম্পদের চেয়ে বেশি মূল্যবান ।  এর মাধ্যমে কোম্পানির কর্মীদের উন্নত মনোবল তৈরি করা যায় ।  

যথাযথ জনবল নিয়োগ করলে অপচয় কমিয়ে এবং উৎপাদন দক্ষতা বাড়িয়ে প্রতিযোগীর তুলনায় উৎপাদন খরচ কমিয়ে  মূল্য প্রতিযোগিতায়ও টিকে থাকা যায় । বেশিরভাগ কোম্পানি আজকাল এই বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে সমস্ত কৌশল গ্রহণ করে । 

দক্ষ  এবং সন্তুষ্ট জনসম্পদের পক্ষেই তার ক্রেতা বা অডিয়েন্সকে যথাযথ সন্তুষ্টি দিয়ে  কোম্পানির লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে থাকা সম্ভব । স্টাফিং একটি বহু ধাপ  বিশিষ্ট প্রক্রিয়া, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে- কর্মীবাহিনীতে কতজন এবং কি ধরনের ব্যক্তি লাগবে তা নির্ধারণ করা(workforce planning), নিয়োগ, নির্বাচন, প্রশিক্ষণ, পারিতোষিক এবং কার্যসম্পাদন মূল্যায়ন ।

আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে যে কোন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের বিলম্বের অন্যতম কারণ হচ্ছে যথাযথ স্টাফিং না হওয়া । যেখানে যেই পরিমান জনবল প্রয়োজন কোন সময়েই সেই জনবল পাওয়া যায় না ।  বিশেষ করে সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পে যথাযথ জনবল অনেকটা দূরআশার মত । ব্যক্তিগতভাবে নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে এই সমস্যা মোকাবেলা করেছি । সরকারি প্রকল্পসমূহ যথাযথ স্টাফিং করতেই কয়েকবছর সময় নষ্ট হয়ে যায় । জনবল নিয়োগ করতে গেলে জনপ্রশাসন (সংস্থাপন) ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্রের প্রয়োজন হয়, তা পেতেই কয়েক বছর পেরিয়ে যায় প্রকল্পসংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের এবং প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের । 

অনেক সময় এমন জনবল পাঠানো হয় যারা হয়তো প্রকল্পের মেয়াদের শেষ দিকে কাজে লাগবে ।  কিন্তু তাদেরকে নতুন প্রকল্পের পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে,  কারণ এই জনবল অন্য আরেকটি  প্রকল্পের উদ্বৃত্ত জনবল । প্রকল্প শেষ হয়ে গেছে, প্রকল্পের  জনবলকে রাজস্ব খাতে নেয়ার সীমাবদ্ধতা থাকায় আত্মীয়তা, ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগকৃত পুর্ববর্তী প্রকল্পের অদক্ষ কর্মীদের নতুন প্রকল্পে স্থানান্তর করা হয় । 

ইমারত নির্মাণ প্রকল্পের শুরুতেই তিনজন গার্ডেনার পাঠানো হয়েছে । সিকিউরিটি গার্ডের  পদ এখনও বরাদ্দ হয়নি । আর এই প্রক্রিয়ায় আরো এক বছর সময় লাগতে পারে ।  অর্থাৎ উদ্বৃত্ত জনবলের তিনজন  গার্ডেনার আরো কয়েক বছর নতুন প্রকল্পে গিয়ে বসে বসে বেতন পাবে ।  কারণ ভবন নির্মাণের কাজ শেষ হওয়ার আগে গার্ডনারের  ওখানে  কোন কাজ নেই ।

প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে নৈপুণ্যের(skill) অভাব অর্থাৎ  কাজটি হাতেকলমে করতে পারে অথবা বাস্তবায়ন পর্যায়ে যে ধরনের অভিজ্ঞতা থাকা দরকার অধিকাংশ প্রকল্প পরিচালকের সেই নৈপুণ্য, অভিজ্ঞতা বা দক্ষতা থাকে না । সরকারি যেকোনো প্রকল্পে প্রায়ই দেখা যায় যুগ্ম সচিবকে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে প্রেরণ করা হয় এবং এরা বেশিরভাগই ক্ষেত্রেই প্রশাসন ক্যাডারের লোক । 

এই প্রকল্প পরিচালক হয়তো কিছুদিন আগেই নরসিংদীর জেলা প্রশাসক ছিল, তারপরে হাওর উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য ছিল, তারপর  স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যুগ্ম সচিব, সর্বশেষ পোস্টিং ছিল প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব । কোন বিবেচনা না করেই তাঁকে হয়তো প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক করে পাঠিয়ে দেয়া হলো । 

পাঠকদের অনেকের হয়তো স্মরণে থাকতে পারে  ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপির ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তদানীন্তন পশুপালন দপ্তর একটি প্রকল্প হাতে নেয় । সেটি ছিল "ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্প"  অর্থাৎ কালো ছাগল পালনের মাধ্যমে গরিব মানুষের ভাগ্য উন্নয়ন করে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করা । উচ্চতার দিক থেকে খাটো এবং তুলনামূলকভাবে দুধ কম দিলেও ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল অন্যান্য জাতের ছাগলের চেয়ে বেশি বাচ্চা প্রসব করে । 

প্রকল্পটির ব্যাপারে তদানীন্তন সরকারের নৌ পরিবহন মন্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল আকবর হোসেন এতই উচ্ছসিত ছিলেন যে চাঁদপুরের ষাটনলে লঞ্চ ডুবিতে যারা নিহত হয়েছিল তাঁদের  পরিবারকে তিনি এক জোড়া করে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন । (কুমিল্লার রাজনৈতিক অঙ্গনের রসিক জনেরা আকবর হোসেনকে "একবার হোসেন" বলতেন । বিএনপি দলীয় এই মন্ত্রী বারবার কুমিল্লা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও তাকে কুমিল্লার উন্নয়ন ও রাজনীতিতে  ততটা মনোযোগ দিতে হয়নি । 

ধানের শীষ মার্কা পেলেই পাস করে আসতেন । কারণ কুমিল্লা রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের একটি অমীমাংসিত চিরস্থায়ী দলাদলি আছে- আফজাল এবং বাহার গ্রুপ । অনেকটা শিয়া-সুন্নিদের মত  অমীমাংসাযোগ্য । নৌকা নিয়ে যেই পক্ষ থেকেই কেউ দাঁড়ালেই অপরপক্ষ তাঁকে ফেল করানোর জন্য  আকবর হোসেন সাহেবকে ভোট দিয়ে জিতেয় দিতেন । অতএব আকবর সাহেব কুমিল্লায় নির্বাচনের সময় "একবার" গেলেই হতো ) 

প্রতি জেলায় একটি করে সরকারি ছাগলের খামার তৈরীর উচ্চাভিলাষ বাদ দিয়ে প্রকল্পটি এখনো চলমান আছে, তবে শুরুতেই প্রকল্পটি দুইতিন বার হোঁচট খায় এবং বন্ধ হয়ে যায় । প্রথম প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান সরকারের যুগ্ম-সচিব আমাদের পরিচিত মুশফিক ভাই । প্রশাসন ক্যাডারের লোক । 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে স্নাতক ( সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী । বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ সজ্জন ব্যক্তি হলেও  মুশফিক ভাইয়ের ছাগল পালন সংক্রান্ত কোন বাস্তব জ্ঞান বা দক্ষতা ছিল বলে আমাদের জানা ছিল না । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের পাঠ্যসূচিতে ভারতবর্ষের ইতিহাসে ছাগল প্রসঙ্গটি মাত্র দুইবার এসেছে ।  

প্রথম এসেছে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে । ছাগল হচ্ছে  প্রাচীনতম প্রাণী যা দিয়ে পশুর গৃহ পালন শুরু হয় । হরপ্পা সভ্যতার নিদর্শনের দেয়াল চিত্রগুলোতে ছাগলের প্রতিনিধিত্ব আছে । মহেঞ্জোদারোর দুটি সিলমোহরের একটিতে খাড়া  লম্বা শিং ওয়ালা বুনো ছাগল,   অন্যটিতে থুতনিতে লম্বা পশমযুক্ত  এবং দুই দিকে  সমান্তরাল  শিং ওয়ালা গৃহপালিত ছাগলের প্রতিচ্ছবি ছিল ।  ভারতবর্ষের ইতিহাসে আরেকবার ছাগল আলোচনায় আসে সেটা মহাত্মা গান্ধীকে কেন্দ্র করে । 

মহাত্মাগান্ধী গরু ও মহিষের দুধ খাওয়া বন্ধ করেছিলেন প্রাণীর প্রতি নির্যাতনের প্রতিবাদে, কারণ তিনি মনে করতেন বাছুরকে বঞ্চিত করে দুধ নিয়ে নেয়া হয় ।  কিন্তু ১৯১৮ সালের ১২ ই আগস্ট গান্ধীজী অসুস্থ হয়ে পড়েন । স্ত্রী কসতরা গান্ধীর পীড়াপীড়ীতে ও ডাক্তারের পরামর্শে তিনি ছাগলের দুধ খেতে রাজি হন । এরপর থেকে গান্ধীর অনুসারীরা দুধ সরবরাহ নিশ্চিতের  ব্যাপারে এতই যত্নশীল ছিলেন যে গান্ধীজী বিলেত যাওয়ার সময়ও ছাগল সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন ।  এ প্রসঙ্গে সরোজিনী নাইডু বলেছিলেন, "it is becoming a costly  affair to keep gandiji in poor conditions" । 

গান্ধীজীর ছাগলের নাম ছিল 'নির্মলা' । বাংলাদেশের মানুষ গান্ধীজিকে স্মরণ করে ১৯৪৬ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়লে মহাত্মা গান্ধী নোয়াখালী উপকূল অঞ্চলে সফর করে গ্রামে গ্রামে উগ্র জনতাকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন । নোয়াখালীতে অবস্থানকালে কিছু গান্ধী বিরোধী লোক তাঁর  ছাগল চুরি করে নিয়ে যায় । 

এই দুইটি প্রেক্ষিত বাদ দিলে  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ভারতবর্ষের ইতিহাসের সিলেবাসে ছাগল বিষয়টি একেবারেই অনুপস্থিত । ইতিহাসের ছাত্র মুশফিক ভাই সরকারের যুগ্ম সচিব হিসেবে ছাগল পালন প্রকল্পের  প্রকল্প পরিচালক হিসেবে যোগ দেন । প্রকল্পের অবস্থা যা হওয়ার তাই হল । নৈপুণ্যের অভাবে এবং যথাযথ স্টাফিং না হওয়ায় তিন বছরের মধ্যেই ছাগলের প্রকল্পটি নিজে নিজেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল । 

কথিত আছে প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট লোকেরাই কিছু ছাগল (🐐) বিক্রি করে দেয়, বাকিগুলো নিজেরাই জবাই করে খেয়ে ফেলে । সরকারের ৩০ কোটি টাকার প্রকল্পের প্রারম্ভিক পর্বের এভাবেই সমাপ্তি ঘটে । কয়েক বছর বন্ধ থাকার পর সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে নতুন করে প্রকল্পটি ঢেলে সাজানো হয় । 

প্রথম পর্বে ছাগল পালনে ব্যর্থ হওয়ার পর  ওই একই মন্ত্রণালয়  আরেকটি প্রকল্প গ্রহণ করেছিল ।  সেটা হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী অঞ্চলের পরিবহন সমস্যা সমাধান করার জন্য "গাধা প্রজনন প্রকল্প" । প্রকল্পের ধারণা পত্রে বলা হয় দুর্গম পাহাড়ী রাস্তা পাড়ি দিয়ে ওই অঞ্চলের আদিবাসীরা তাদের উৎপাদিত কৃষিজ পণ্য বাজারে আনতে বহু সমস্যার সম্মুখীন হয় । এর একমাত্র সমাধান হতে পারে পরিবারগুলোকে যদি একটি করে গাধা দিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে  তাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারে আনতে কোন সমস্যা থাকবে না । এর মধ্য দিয়ে পার্বত্য অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন তথা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে‌ ।  ভারত থেকে ১৭ গাধা নিয়ে আসা হল । 

সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে ছাগল পালন প্রকল্পের ব্যর্থ প্রকল্প পরিচালক ইতিহাসবিদ মুশফিক ভাইকেই আবার "গাধা প্রজনন প্রকল্পে"র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলো‌ । যারা ব্যর্থ ছাগল পালন প্রকল্প সম্পর্কে জানতেন তারা এই খবরটি জানতে পেরে একটাই মন্তব্য করেছিলেন, "প্রকল্পে মোট ১৮ টি  গাধার সমাবেশ ঘটলো" । এই প্রকল্পেরও একই পরিণতি হয়েছিল । অবশ্য গাধা জবাই করে কেউ খায়নি । রোগবালাই, অযত্ন-অবহেলায় সবকটি গাধার মৃত্যুর মধ্য দিয়েই সরকারের গাধা প্রজনন প্রকল্প সমাপ্ত হয় ।

যেকোন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যেটা বেশি প্রয়োজন সেটা হচ্ছে স্কিল । প্রশাসনিক ক্যাডার সার্ভিস থেকে আগত প্রকল্প পরিচালকদের যেটা থাকে সেটা হচ্ছে নলেজ । প্রকল্প প্রণয়নের সময় নলেজ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ,  কিন্তু বাস্তবায়নের সময় স্কিল বা নৈপুণ্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ।  যাদের নলেজ এবং  স্কিলের পার্থক্য সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট নয় তাদের জন্য একটি উদাহরন দিচ্ছি ।  

ধরা যাক আপনার বাসার টেলিভিশনটি  "ঝিরঝির" করছে । আর আপনি এই টেলিভিশনটি একটা রিকশায় করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লাইড ফিজিক্স এন্ড ইলেকট্রনিক্স বিভাগের নিয়ে গেলেন । সিনিয়র অধ্যাপক ড. সুব্রত কুমার আদিত্য, টেলিভিশন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক । তাঁর কাছে গিয়ে বললেন," স্যার আমার টেলিভিশনটা ঠিক করে দেন" ।  আপনি নিশ্চিত থাকেন সুব্রত বাবু আপনার টেলিভিশন ঠিক করতে পারবেন না । সেখান থেকে রিকশায় করে টেলিভিশনটি নিয়ে আসলেন নীলক্ষেত । 

নীলক্ষেতে বাকুশা মার্কেটের ভিতরে একটা মেকানিক্সের দোকানে এক মিস্ত্রি বসে বসে সারাদিন এটা সেটা ঠিক করে । তাকে বললেন, "ভাই আমার টেলিভিশনটা "ঝিরঝির" করে, একটু ঠিক করে দেন"। ওই মেকানিক  কিছুক্ষণ খোঁচাখুঁচি  করেই আট দশ মিনিটের মধ্যেই আপনার টেলিভিশনটি ঠিক করে ফেলল। তারপর আপনি ওই মেকানিকে  প্রশ্ন করলেন, "মেকানিক  ভাই, আমাকে একটু বুঝানতো- টেলিভিশনে ছবি কেন দেখা যায় ?"  আপনি নিশ্চিত থাকেন মেকানিক  আপনার এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারবেন না  । 

এই প্রশ্নের জবাব পেতে হলে আপনাকে আবার যেতে হবে অ্যাপ্লাইড ফিজিক্স এন্ড ইলেকট্রনিক্স ডিপার্টমেন্টে । সেখানে গিয়ে সুব্রত বাবুকে বলতে হবে, " দাদা, টেলিভিশনের ছবি কেন দেখা যায় ?"  তখন সুব্রতবাবু বলবে, " আপনার কি সময় হবে ?  দেড় ঘন্টা সময় আছে ? তাহলে চলুন আমার সাথে  ক্লাসে" । 

ক্লাসে গিয়ে আপনি  বসছেন, তারপর সুব্রত বাবু বোর্ডে মার্কার দিয়ে একটি সার্কিট এঁকে আপনাকে বুঝিয়ে দেবে এই কারণে টেলিভিশনে ছবি দেখা যায়  । অর্থাৎ সুব্রতবাবুর যেটা আছে সেটা হচ্ছে নলেজ, আর মেকানিকের  যেটা আছে সেটা হচ্ছে স্কিল । আমাদের দেশের প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জ্ঞান হয়তো থাকে, কিন্তু নৈপুণ্যের বড়ই অভাব ।

সিরিজের সর্বশেষ "S" টি হচ্ছে স্টাইল(style) । এক্ষেত্রে স্টাইল বলতে বোঝানো হয় প্রকল্প বাস্তবায়নের সাথে যারা সংশ্লিষ্ট থাকবে তারাতো সমমনা(shared values) হবেই, যেটা আগে উল্লেখ করেছিলাম;  এখানে এসে বলা হচ্ছে শুধু তারা সমমনাই হবেন না, তারা একইভাবে আচরণও করবে, অর্থাৎ কর্মক্ষেত্রে তারা একটি নির্দিষ্ট নির্দেশনা অনুসরণ করে সংশ্লিষ্ট সবাই  একইভাবে কাজটি করবে ।  

ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায় সেনাবাহিনী প্রকল্প বাস্তবায়নে অন্যান্যদের চেয়ে বেশি পারদর্শিতা দেখায় । যার কারণে পৃথিবীতে যত জটিল এবং দুর্গম প্রকল্প নেয়া হয়েছিল এর বেশিরভাগই সেনাবাহিনী দিয়ে  বাস্তবায়ন করার ঐতিহাসিক নজির আছে । সেনাবাহিনীর সবাই দলনেতাকে অনুসরণ করে তাদের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে।  তাদের হাটা, চলা, বসা, খাওয়া সবাই একই স্টাইলে হয়। 

আপনি যদি সেনাবাহিনীর  কোন ব্যারাকে যান সেই ব্যারাকে যদি ৭৫০  সৈনিক থাকে, আপনি পরীক্ষা করে দেখতে পারেন প্রত্যেকের মশারি এমন ভাবে ভাঁজ করা আছে একটা মশারির সাথে আরেকটা মশারির ভাঁজের সামান্যতম পার্থক্যও খুঁজে পাবেন না, এটা পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নাই । তাঁরা একই রকম মগে পানি খায়, একই রকম ভাবে চুল কাটে, একইরকমভাবে তালে তালে হাটে‌ ।  একটি  হুইসেল দিলে সবাই রেডি হয়ে যায় ।  আর একটা  হুইসেলে সবাই মাটিতে শুয়ে যায় ।  এভাবেই চলে সেনাবাহিনী লোকদের প্রাত্যহিক জীবন ।  এটাই তাদের স্টাইল । কেন এমন করতে হবে তারা কখনো কাউকে এই প্রশ্ন করেনা ।  

উর্দ্ধতন বসের নির্দেশনা, সেটাই তাঁরা মেনে চলে । কোথায়ও সেনাবাহিনী আছে কিনা সেটা বুঝবেন কিভাবে ।  ধরুন, আপনি লং রুটে কোথাও যাচ্ছেন । যখন দেখবেন রাস্তার দুই পাশে গাছের গোড়ায় চুন দেখা যাচ্ছে, সেখানে নামলেই আশেপাশে ক্যান্টনমেন্ট বা সেনা ক্যাম্পে পেয়ে যাবেন । সামরিক বাহিনীর লোকরা যেখানেই যায় প্রথমেই গাছের গোড়ায় চুন দিয়ে দেয় । এটাই তাদের স্টাইল ।  

আমি একবার আমার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখি আমাদের পুকুর পাড়ের সবকটা নারিকেল গাছের গোড়ায় চুন ।  আমিতো ভয় পেয়ে গেলাম । আমাদের বাড়ি ক্যান্টনমেন্ট হয়ে গেল নাকি !  পরে যেটা জানতে পারলাম, আমাদের বড় ভাই, লতিফ ভাই, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা যশোরে থাকেন । ছুটিতে বাড়িতে এসে  সেনা কর্মকর্তা সাহেব তাঁর নিজের বাড়ির নারকেল গাছের গোড়ায় চুন লাগিয়েছেন । যেমনটি যশোর সেনানিবাসে করেছেন । 

একটু লক্ষ্য করলে দেখবেন আমাদের সেনাবাহিনীর লোক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর কাজ করতে   সিওরে লিওন গিয়েও গাছের গোড়ায় চুন দিয়েছে । আমি বিটিভিতে একটি অনুষ্ঠানে শান্তিরক্ষী বাহিনীর কর্মকান্ডের উপর একটি ডকুমেন্টারিতে গাছের গোড়ায় চুন দেখেছিলাম । সেনাবাহিনী যেখানেই যাবে সেখানে গাছের গোড়ায় চুন দিবেই । 

আমার এক ছাত্র ছিল সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার, খুবই মেধাবী,  তাকে ক্লাসে জিজ্ঞেস করেছিলাম, "ব্রিগেডিয়ার সাহেব, বলুনতো আপনারা সেনাবাহিনীর লোকেরা গাছের গোড়ায় চুন কেন লাগান । তাঁর উত্তর ছিল, "জানি না স্যার,  ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসছে স্যার, ব্রিটিশরা লাগাতো আমরাও লাগাচ্ছি; এটা স্টাইল,  স্যার" । 

ফুলার রোডের আমার বাসার পাশেই থাকতেন  বোটানির সিনিয়র অধ্যাপক মোজাম্মেল স্যার । একদিন বিকেলবেলা স্যারকে পেয়ে গেলাম । 

জিজ্ঞেস করলাম, "স্যার সেনাবাহিনীর লোকেরা গাছের গোড়ায় যে চুন লাগায় এতে কি গাছের কোন উপকার হয় ? স্যার একটু ভেবেচিন্তে আমাকে বললেন, "হ্যাঁ, কিছু উপকার তো হয় বটেই, তবে গাছের বেশি উপকার হত যদি সেনাবাহিনীর লোকেরা ওই চুন গুলো  সরাসরি গাছের গোড়ায় দিয়ে দিত। 

কারণ বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে  চুনে থাকা উপকারী ক্যালসিয়াম গাছের গোড়ায় গিয়ে পৌঁছেতে অনেক সময় লেগে যায়" । পরের ক্লাসে আমার ব্রিগেডিয়ার ছাত্রটিকে বলেছিলাম, "ব্রিগেডিয়ার সাহেব, মোজাম্মেল স্যার বলেছেন আপনাদের চুনগুলো গাছের গায়ে না লাগিয় সেগুলো গাছের গোড়ায় দিলে ভালো হবে । 

গাছের ক্যালসিয়ামের ঘাটতি দ্রুত পূরণ হবে ।" আমার কথা শুনে ব্রিগেডিয়ার সাহেব বললেন,  "এটা করা যাবে না স্যার"। আমি জিজ্ঞেস করলাম কেন? "স্যার, স্টাইল স্যার"।

লেখক: অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান
অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এমএসি/আরএইচ