পারাবত ট্রেনের পাওয়ার কার ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ

সোমবার ১৩ জুন ২০২২ ১১:১৩


মৌলভীবাজার প্রতিনিধি ::
আগুনের কারণ খুঁজতে তদন্তে তিন কমিটি। রহস্যজন আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত পারাবত আন্তঃনগর এক্সপ্রেস ট্রেনের পাওয়ার কারের স্বাভাবিক চলাচলের মেয়াদ ছিল না।

লোকোশেডে থাকার কথা থাকলেও সেটি চালানো হচ্ছিল মেরামত করে। ফলে টানা সার্ভিস দিতে গিয়ে পাওয়ার কারটিতে আগুন লাগে। এছাড়া পাওয়ার কারে ছিল না অগ্নিনির্বাপণের কোনো ব্যবস্থাও। তদন্ত সংশ্লিষ্ট এবং রেলওয়ে বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এদিকে আন্তঃনগর পারাবত ট্রেনে অগ্নিকাণ্ডে তিনটি বগি পুড়ে যাওয়ার ঘটনায় গঠিত তিনটি তদন্ত কমিটি এর মধ্যে কাজ শুরু করেছে। রোববার (১২ জুন) সকালে শুরু হওয়া তদন্ত মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শমসেরনগর চককবিরাজী দুর্ঘটনা এলাকায় পরিদর্শন করেন বাংলাদেশ রেলওয়ের বিভাগীয় তদন্ত কমিটি। জেলা প্রশাসকের তদন্ত কমিটি তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে। প্রাথমিক তদন্তে এসব ধরা পড়ে।

রেলওয়ে সূত্র মতে বলছে, আমদানির পর ২০১৭ সালে পাওয়ার কারটি চলাচলের ট্রেনে জন্য সংযুক্ত করা হয়। একটি পাওয়ার কার সর্বোচ্চ ২০ হাজার ঘণ্টা পর্যন্ত স্বাভাবিক সার্ভিস দিতে পারে। সেই হিসাবে পারাবত আন্তঃনগর ট্রেনের পাওয়ার কারটি লোকোশেডে ফেরতযোগ্য।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় জোনের চিফ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার অজয় কুমার পোদ্দার বলেন, ‘আমদানি করার পর যে কোনো পাওয়ার কার রেলওয়েতে যুক্ত হওয়ার পর সর্বোচ্চ ২০ হাজার ঘন্টা পর্যন্ত স্বভাবিক সার্ভিস দিতে পারে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পারাবত ট্রেনে যুক্ত পাওয়ার কারটি ২০১৬-১৭ সালের দিকে আমদানি করা। সেদিক থেকে ২০২১ সালেই এটি লোকোশেডে ফেরত যাওয়ার কথা ছিল।’

রেল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আন্তঃনগর ট্রেন প্রতিদিন আপ অ্যান্ডডাউনে চলাচল করে। সেই হিসেবে প্রতিটি পাওয়ার কার সপ্তাহে ৬ দিন ১৪ ঘন্টা করে সার্ভিস দেয়। আর বর্তমানে প্রতিটি আন্তঃনগর ট্রেনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কোচের সংখ্যা আগের চেয়ে বাড়ানো হয়েছে। ফলে একটি পাওয়ার কার ২০ হাজার ঘন্টাও চলার কথা নয়।

রেলওয়ের বিভাগীয় পর্যায়ে তদন্ত কমিটির প্রধান বাংলাদেশ রেলওয়ের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা মো. খায়রুল কবির বলেন, পূর্ণাঙ্গ তদন্ত ছাড়া কিছুই বলা যাবে না। একটু সময় লাগবে। আমরা পরীক্ষানিরীক্ষা করছি। সবকিছু দেখতে হচ্ছে, বিভিন্ন মেজারমেন্ট পরিলক্ষিত করে নিতে হবে।

ওই ট্রেনে দায়িত্বরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে কথা বলে বক্তব্য নিতে হবে, সেটিতো মেকানিক্যাল বিষয়। কোন জায়গায় কি ছিল, কিভাবে হতে পারে, সবকিছু দেখার সাপেক্ষে সম্পুর্নরুপে তথ্যের ভিত্তিতে বলা যাবে আগুন লাগার প্রকৃত কারণ।

মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটি প্রধান মৌলভীবাজার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবদুল হক বলেন, আমরা তদন্ত শুরু করেছি। আমাদের তদন্ত কমিটির সব সদস্যের সাথে আলোচনা হয়েছে। আশা করি ২/১ দিনের মধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে কথা বলে শিগগিরই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে পারবো। তখন বলতে পারব কি কারণে আগুন লেগেছে।

পারাবত আন্তঃনগর ট্রেনের পরিচালক মো. ইসমাইল বলেন, ট্রেন ঢাকা ছেড়ে ব্রাক্ষণবাড়িয়া এলাকায় আসার পর ট্রেনের হোস পাইপে সমস্যা দেখা দেয়। হোস পাইপ মেরামত ট্রেনটি সিলেটের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। ট্রেনটি শমসেরনগর স্টেশন অতিক্রম করার পর ট্রেনের পাওয়ারকার থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। ট্রেন থামানোর পর দেখা যায় চাকার মধ্যে আগুন ও পরে পাওয়ারকারের ভেতর তেলের ট্যাংকিতে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে।

কুলাউড়া রেলওয়ে স্টেশনের প্রধান মাস্টার মো. মহিবুর রহমান জানিয়েছেন. অগ্নিকাণ্ডে পারাবত আন্তঃনগর এক্সপ্রেসের পুড়ে যাওয়া তিনটি বগি কুলাউড়া জংশন রেলওয়ে স্টেশনে রাখা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত বগিগুলো পরির্দশন করেছেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা।

ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা সিলেটগামী আন্ত:নগর ট্রেন পারাবত এক্সপ্রেসে অগ্নিকান্ডে তিনটি বগি পুড়ে গেছে। গত (১১ জুন) শনিবার মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শমসেরনগরে চককবিরাজী এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। তবে এতে কেউ হতাহত হয়নি। দেড় ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিস। ওই পথে প্রায় চার ঘণ্টা পর রেল চলাচল সিলেটের সাথে স্বাভাবিক হয়।

এ ঘটনা খতিয়ে দেখতে ওই দিন বিকালেই বাংলাদেশ রেলওয়ে বিভাগীয় পর্যায়ে দুটি তদন্ত কমিটি এবং মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

প্রত্যক্ষদর্শী ও সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছেন, পাওয়ারকার বগি থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত। ঘটনার পর সারা দেশের সঙ্গে সিলেটের ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। আগুন নিয়ন্ত্রণে এলে প্রায় ৪ ঘণ্টা পর আবারও ট্রেন চলাচল শুরু হয়। 

শমসেরনগর রেলওয়ের স্টেশন মাস্টার জামাল উদ্দিন বলেন, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ছাড়া নির্ণয় করা সম্ভব নয়। স্থানীয়দের ভাষ্য, চলন্ত ট্রেনের পাওয়ারকার বগি থেকে আগুনের সূত্রপাত। এ সময় আতঙ্কে যাত্রীরা চিৎকার-চেঁচামেচি করতে থাকেন। চালক দ্রুত ট্রেন থামিয়ে দেন। আতঙ্কগ্রস্ত যাত্রীরা হুড়োহুড়ি করে নামতে থাকেন। 

স্থানীয় লোকজন পানি-বালু দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু আগুনের তীব্রতা বাড়তে থাকায় তারা সরে আসতে বাধ্য হতে থাকেন। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কুলাউড়া, কমলগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল ও মৌলভীবাজার ইউনিট গিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা চালায়। দেড় ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। ততক্ষণে ট্রেনের তিনটি বগি ভস্মীভূত হয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১২টি বগি। 

প্রত্যক্ষদর্শী জিল্লুর রহমান মাহিন বলেন, ট্রেনটি শমসেরনগর রেলস্টেশন থেকে বিমানবন্দর এলাকায় যাওয়ার পর হঠাৎ আগুন লাগে। এ সময় ট্রেন থামালে যাত্রীরা হুড়োহুড়ি করে নামতে শুরু করেন। একপর্যায়ে আগুনের লেলিহান শিখা ভয়ংকর রূপ ধারণ করে।

ট্রেন না থামালে অনেক প্রাণের ক্ষতি হতো। তীব্রতা অনেক বেশি থাকায় স্থানীয়রা আগুনের কাছে ঘেঁষতে পারেননি। পরে ফায়ার সার্ভিসের চারটি ইউনিট গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। 

শমসেরনগর রেলওয়ের স্টেশন মাস্টার জামাল উদ্দিন বলেন, ট্রেনের ১০ নম্বর বগিটি ছিল পাওয়ার সার্ভিসের। পাওয়ার সার্ভিস বগির সামনের ও পেছনের বগিসহ তিনটি বগি পুড়ে যায়। প্রথমে সামনের আটটি বগি কুলাউড়া রেলস্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয়। আর পেছনের চারটি বগি শমসেরনগর রেলস্টেশনে নিয়ে রাখা হয়েছে। পুড়ে যাওয়া তিনটি বগি উদ্ধার করেছে রেলওয়ের উদ্ধারকারী দল।

মৌলভীবাজার ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ হারুন পাশা বলেন, আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিসের চারটি ইউনিট যৌথভাবে কাজ করে। প্রায় দেড় ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন তারা।

আগুন লাগার বিষয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে ট্রেনের পাওয়ার সার্ভিসের বগি থেকে আগুনের সূত্রপাত। তবে তদন্ত করে সূত্রপাত কারন ও সঠিক তথ্য জানা যাবে। 

কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সিফাত উদ্দিন বলেন, ধারণা করা হচ্ছে পাওয়ার সার্ভিস বগি থেকে আগুনের সূত্রপাত। তবে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি এবং সব থেকে বড় বিষয় মানবজীবনের কোন রকম ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।

এমএসি/আরএইচ