দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয়া নওগাঁর কছির উদ্দিন আকন্দ চান রাষ্ট্রীয় মর্যাদা

বুধবার ১৫ জুন ২০২২ ১৯:১০


:: অহিদুল ইসলাম, নওগাঁ প্রতিনিধি ::
 
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে বৃটিশ বাহিনীর হয়ে অংশ নেয়া নওগাঁ সদর উপজেলার তিলকপুর ইউনিয়নের নগর কুসুম্বি গ্রামের মৃত- রসুল্লা আকন্দের ছেলে কছির উদ্দিন আকন্দের বয়স প্রায় ৯৭ বছর। ১৯২৫ সালে জন্ম নেয়া এ বৃদ্ধকে দেখে বোঝার উপায় নেই পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহতম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীর সৈনিক তিনি। 
 
বীরত্বের জন্য বেশ কিছু পদকও পেয়েছেন। যুদ্ধের ভয়াবহতার প্রত্যক্ষদর্শী কছির উদ্দিন আকন্দ পরে চাকরী ছেড়ে বেসামরিক জীবনে ফিরেও এসেছিলেন। পরিবার ও স্থানীয়দের দাবী এলাকায় কছির উদ্দিনের নামে এমন কিছু তৈরি করা হোক যার মাধ্যমে কছির উদ্দিন প্রজন্মের পর প্রজন্ম স্মরনীয় ও বরনীয় হয়ে থাকবেন। 
 
কছির উদ্দিন আকন্দ এখনো কারো সহায়তা ছাড়াই ঘরে বাইরে চলা ফেরা করতে পারেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন মসজিদে গিয়ে। চশমা চাড়াই বাড়িতে কোরআনশরীফ ও পত্রিকা পড়েই সময় কাটে তার। স্মরণশক্তিও আছে আগের মতো। জীবনের শেষ সময়ে এসে তিনি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেতে চান। কছির উদ্দিন আকন্দ দেশ তথা নওগাঁর জন্য এক জীবন্ত গৌরব। তাই এই বৃটিশ সৈনিকের নামে এলাকায় এমন কিছু স্থাপনা নির্মাণ করা হোক যা দেখে বর্তমান ও আগামী প্রজন্ম জানবে কছির উদ্দিন সম্পর্কে। আর যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন কছির উদ্দিনের নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে। 
 
১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর শুরু এবং ১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর শেষ হওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক পক্ষে ছিল বৃটিশ, আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং অন্য পক্ষে ছিল জার্মানি, জাপান ও ইতালি। বৃটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির হয়ে বিশ্বযুদ্ধে লড়াইকারী পূর্ববাংলার যুদ্ধফেরত নয়জন বাংলাদেশী সৈনিকের তথ্য পাওয়া যায়, যারা এখনো বেঁচে রয়েছেন। বিশ্বযুদ্ধে অবদান ও বৃটিশ সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক সদস্য হিসেবে বৃটিশ সরকারের কাছ থেকে ভাতা-সহায়তাও পাচ্ছেন তারা। পিএনআর (পাইওনিয়ার কোর) কছির উদ্দিন আকন্দ এদের মধ্যে অন্যতম।
 
পূর্ববাংলা তথা বাংলাদেশে যারা এখনো বেঁচে রয়েছেন তারা হলেন, পিএনআর (পাইওনিয়ার কোর) কছির উদ্দিন আকন্দ, হাবিলদার সাবেদ আলী সরকার, ল্যান্স নায়েক আব্দুল মান্নান, ল্যান্স কর্পোরাল সামছুদ্দিন, সৈনিক মতিয়ার রহমান, সৈনিক আবুল হোসেন, স্যাপার নূর মোহাম্মদ, ল্যান্স কর্পোরাল নূর মোহাম্মদ ও হাবিলদার নজির আহমেদ। 
 
এক আলাপচারিতায় বৃটিশ সৈনিক কছির উদ্দিন আকন্দ জানান, সেই সময় আমার পরিবারে খুব অভাব ছিলো। সংসারের অভাবের তাড়নায় ১৯৪৪ সালের ৫ মার্চ নওগাঁর তৎকালীন কালেক্টরেট চত্বরে এসে দেখি বৃটিশ বাহিনীর জন্য সৈনিক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। তখন লাইনে দাড়ানোর পর তিনি বৃটিশ বাহিনীর সৈনিক হিসেবে নিয়োগ পান। এরপর সেখান থেকে কলকাতায় এক মাসের রাইফেল ট্রেনিংয়ের পর বৃটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির পাইওনিয়ার (পিএনআর) পদে যুক্ত হন। বোম্বাইয়ে (বর্তমান মুম্বাই) জাপানি বিমান হামলার পর বেশ কিছুদিন শহরটির পুনর্নিমাণ কাজে অংশ নেন। এরপর পুনেতে সম্মুখ যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাকে পাঠানো হয় বার্মায় (বর্তমান মায়ানমার)। সেখানে বিশাল এবং ঘন অরণ্যে হিংস্র নানা জীবজন্তুর মধ্যে অত্যন্ত কষ্টকর দিন কেটেছে তাদের। সেখানে বাহিনীর অন্য সদস্যদের সাথে কথা বলাও ছিল দুষ্কর। সেখানে আফ্রিকানসহ ১১ জাতির সৈন্য দিয়ে তাদের ইউনিটটি গড়ে তোলা হয়েছিল। প্রায় এক বছর জঙ্গল থেকে যুদ্ধ করার পর জাপানী বাহিনীকে দমনে সক্ষম হন তারা। এরপর আত্মসমর্পনকারী কয়েক হাজার জাপানি সৈনিকসহ বৃটিশ বাহিনীর সৈনিকরা মায়ানমার শহর পুনরায় গড়ে তোলার কাজে লেগে যায়। আর এক মাসের ছুটি নিয়ে নওগাঁয় নিজ বাড়িতে চলে আসেন তিনি। ছুটি কাটানোর পর তিনি যোগদেন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে। এরপর আবারো তাকে পাঠানো হয় বার্মায়। সেখানে জাপানী যুদ্ধবন্দিদের দিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকার পুনর্গঠন কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। 
 
তিনি আরো বলেন, যুদ্ধে অংশগ্রহণের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৩৯-৪৫ স্টার, বার্মা স্টার মেডেল, ওয়ার মেডেল পেয়েছি। ১৯৪৮ সালের ১৭ আগস্ট সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বাড়ি ফিরে আসি। বাড়িতে ফিরে আসার পর সংসারের অভাবের তাড়নায় ১৯৪৭ সালের পর খুলনা আদমজী জুট মিলে নিরাপত্তা কর্মীর চাকরী করে কোন মতে সংসার চালাতাম। এরপর দেশ স্বাধীন হলে জুট মিল বন্ধ হয়ে গেলে আবার আমি এলাকায় এসে দিনমজুর ও কৃষি কাজ করে পরিবার নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতাম। বার্ধক্যজনিত কারণে বিভিন্ন রোগব্যাধি বাসা বেঁধেছে শরীরে। বর্তমানে আমি অনেক রোগে আক্রান্ত। বৃটিশ ভাতা দিয়ে রোগের চিকিৎসা ও সংসার চালাতে আমি হিমশিম খাচ্ছি। আমি তিন মাস পরপর সশস্ত্রবাহিনী রাজশাহী ডিএএসবি অফিস থেকে ১৬হাজার টাকা ভাতা পাই। সেটা দিয়েই কোনো ভাবে খাবার ও ওষুধ খেয়ে বেঁচে আছি। ৯৭ বছর বয়স হয়েছে আমার। 
 
তিনি আরোও বলেন, যুদ্ধ শেষে আমাকে যুক্তরাজ্যে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল বৃটিশ সরকার। দেশের কথা ভেবে দেশেই ফিরে আসি আমি। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘দেশে মুক্তযোদ্ধাদের রাষ্ট্রিয় ভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। আমাকে তো কেউ মূল্যায়ন করছে না। কেউ আমায় কখনো ডাকেনা, খোঁজ খবর নেয় না। কোন জাতীয় অনুষ্ঠানেও আমাকে কেউ সম্মান দিয়ে ডাকে না। হয়তো যে কোনো দিন আমি মরে যাবো। মৃত্যুর পরে নয়, আমি বেঁচে থাকতেই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চাই।’ 
 
কছির উদ্দিন আকন্দের স্ত্রী রেহেনা বেগম বলেন আমি কছির উদ্দিন আকন্দের দ্বিতীয় স্ত্রী। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি আমাকে বিয়ে করেন। বর্তমান আমাদেরকে নাতি-নাতনিদের সহায়তার উপর নির্ভর হয়ে থাকতে হয়। আমার স্বামীর চিকিৎসার ব্যয় অনেক। তাই সরকার যদি আমার স্বামীকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদার পাশাপাশি আর্থিক সহায়তা করতো তাহলে হয়তো আমাদের বাকি জীবন একটু স্বাচ্ছন্দে কাটতো।
 
তিলকপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম বলেন, আমরা সৌভাগ্যবান যে বৃটিশ সৈনিক কছির উদ্দিন এখনোও আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন। আমি তার নামে কোন একটি রাস্তার নামকরন করতে এবং তাকে জেলা প্রশাসন ও সরকারের পক্ষ থেকে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান করার জন্য বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মহলকে জানাবো। এছাড়া আমার ইউনিয়ন পরিষদ থেকে যে সকল সুযোগ-সুবিধা রয়েছে তা আমি কছির উদ্দিনকে প্রদান করতে চেষ্টা করবো। 
 
জেলা প্রশাসক খালিদ মেহেদী হাসান বলেন, দেশের প্রতিটি বয়স্ক নাগরিকদের জন্য আমাদের সহানুভুতি এবং সহযোগীতা সব সময় থাকে। বৃটিশ বাহিনীর হয়ে বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয়া কছির উদ্দিন আকন্দের অবদানকে আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমরা যে সব সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে থাকি তা মূলত ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহনকারী বীর সেনাদের জন্য। অন্য কোন যুদ্ধে অংশ গ্রহনকারীদের জন্য নয়। তিনি যেহেতু বৃটিশ সরকারের পাঠানো এবং বাংলাদেশ সরকারের সশস্ত্রবাহিনী কর্তৃক প্রদত্ত সম্মানী ভাতা পেয়ে আসছেন তার জন্য এর চেয়ে বড় স্বীকৃতি আর কি হতে পারে। তারপরেও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার জন্য যা যা করা সম্ভব আমি তার সবটুকু করার চেষ্টা করবো।

এমএসি/আরএইচ