ডোমারে ছেলের নির্যাতনে স্বামীর ভিটে ছাড়া মা

রবিবার ২০ মার্চ ২০২২ ১৬:৩৫


মোসাদ্দেকুর রহমান সাজু, ডোমার ::
নীলফামারীর ডোমারে ছেলের নির্যাতনের শিকার হয়ে দীর্ঘ ৭ বছর ধরে স্বামীর ভিটে ছাড়া হয়ে একাকীত্ব অসহায় জীবন যাপন করছেন মা খাদিজা খাতুন (৬৫)। ছেলের অযাচিত আর্থিক চাহিদা মেটাতে না পারায় মানসিক নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে স্বামীর ভিটে ছেড়ে বাবার বাড়িতে অসহায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন তিনি। 

ঘটনাটি ঘটেছে উপজেলার ডোমার সদর ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ড পশ্চিম চিকনমাটি মাদ্রাসা পাড়া গ্রামের মৃত এমএ রব্বানির স্ত্রী খাদিজা খাতুনের সাথে।

 বুধবার ১৬ মার্চ খাদিজা খাতুন তার ছেলে আনোয়ার পারভেজ রনি (৪৫) এর বিরুদ্ধে ডোমার সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মাসুম আহমেদ বরাবরে লিখিত অভিযোগ করেছেন। সেখানে তিনি চেয়ারম্যানের কাছে তার সকল সমস্যার সমাধান পূর্বক দ্রুত তাঁকে তাঁর অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার দাবী জানিয়েছেন।

অভিযোগে খাদিজা খাতুন জানায়, ২০১৪ সালের পহেলা নভেম্বর আমার স্বামী বার্ধক্যজনিত কারনে মৃত্যু বরন করেন। স্বামীর মৃত্যুর পর তার রেখে যাওয়া অর্থ সম্পত্তি আমি নিজেই দেখাশোনা করতাম। হঠাৎ করে আমার ছেলে আনোয়ার পারভেজ রনি তাঁর ব্যক্তিগত প্রয়োজনের জন্য আমার কাছে মোটা অঙ্কের টাকার দরকার বলে আমাকে চাপ প্রয়োগ করে। 

ছেলের সেই আর্থিক প্রয়োজন মেটাতে আমি অসম্মতি জানাইলে আমার ছেলে রনি দিনের পর দিন আমার উপর মানসিক নির্যাতন চালায়, এতে করে যত দিন যায় আমার সাথে তার সমস্যা বাড়তেই থাকে। এমতবস্থায় স্বামীর বাড়ি ত্যাগ করে আমার এক নিকটস্থ আত্মিয়ের বাসায় অবস্থান করি। স্বামীর বাসা ত্যাগ করার পর পরই ছেলে আমার এবং আমার মরহুম স্বামীর নামীয় সম্পত্তি একের পর এক আমাকে অবগত না করেই মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিয়ে অন্যের নিকট বন্ধক রাখে, একপর্যায়ে আমি গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বিষয়টি জানতে পারি, তখন আমার ছেলে রনি বিভিন্ন লোক মারফত বলে যে, আমার বাবা মৃত্যুর আগে তার স্থাবর অস্থাবর সব সম্পত্তি আমার নামে লিখে দিয়েছে, যা সম্পূর্ণভাবে মিথ্যা এবং বানোয়াট ।

অপরদিকে আমার নিজ নামীয় প্রায় ২৫ বিঘা জমি যা আমার ছেলে অন্যের দ্বারা দখল করার পর আমি জানতে পারি জমিগুলো ডোমার সদর ইউনিয়নের নবারপাড়ার আজিজার ওরফে কেন্দেলুর ছেলে একরামুল, মোটাই মুন্সির ছেলে মিজানুর, হামিদুরের ছেলে আমিনুর, মৃত হোলার ছেলে জিয়া, আব্দুল বাকির ছেলে করিমুল, মৃত হামিদুরের ছেলে সেলিম, নালচানের ছেলে মহিদুল, মৃত কাছিমের ছেলে সাত্তার, মৃত ঢেপুর ছেলে রেজা তারা সবাই বর্গা হিসেবে চাষ করার কথা বলে দখল করে আছে। এছাড়াও ডাক্তার পাড়া চওরার বিল এলাকার মৃত সফের আলীর দুই ছেলে আতিয়ার ও ওবাইদুল এবং কবীরের স্ত্রী জেসমিন আক্তার কিছু জমি দখল করে আছেন। সেই জমিগুলোর ফসলের ভাগ জোরপূর্বক ভাবে আমার ছেলে আদায় করে এবং আমাকে সম্পূর্ণরূপে ফসলের ভাগ হতে বঞ্চিত করে রেখেছে।

একপর্যায়ে কান্না জড়িত কন্ঠে খাদিজা খাতুন প্রতিবেদককে বলেন,  আজ আমার এতো অর্থ সম্পত্তি থাকার পরেও আমি অসহায়ের মতো মানবেতর জীবন যাপন করছি। বর্তমানে বয়সের ভারে আমি শারীরিকভাবে ভীষণ অসুস্থ, তাছাড়া অসুস্থ্য অবস্থায় আমি ঘরের ভিতর একাই পরে থাকি খোজ নেয়ার মতো কেউ থাকেনা। 

আমার এতোকিছু থাকার পরেও অর্থাভাবে উন্নত চিকিৎসাও করাতে পারছিনা, বর্তমানে আমার খাওয়া-খরচ আত্মীয়-স্বজনদের সহযোগিতায় চালিয়ে আসছি। ইতিপূর্বে আমার সমস্যাগুলো নিয়ে আমি ও আমার মেয়ে রাফিউ রুবাইয়া জাহান ওরফে রিম্পা মনি (৩৫) সহ নিকটতম আত্মীয়স্বজন ও এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে একাধিকবার সমাধানের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই। আপন ভাইয়ের এমন বিরুপ আচরণের কারনে আমার মেয়ে রিম্পা মনিও পৈতৃক সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। 

আমি গত ১৬ মার্চ ডোমার সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাসুম আহমেদকে অর্থ সম্পত্তিসহ আমার নির্যাতনের বিষয়গুলো উল্লেখ পূর্বক লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। পরিশেষে তিনি আরও বলেন, আমার সকল সম্পত্তি দখল মুক্ত করে আমার স্বামীর রেখে যাওয়া বাড়িতে সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে বাকি জীবনের সময়টুকু একসাথে থাকার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। 

এবিষয়ে খাদিজা খাতুনের ছোট মেয়ে রাফিউ রুবাইয়া জাহান ওরফে রিম্পা মনির সাথে মোবাইল ফোনে ঘটনা সত্যতার কথা জানতে চাইলে তিনি প্রতিবেদককে মুঠোফোনে জানায়, ২০১৪ সালে আমার বাবার মৃত্যু বরন করেন। বাবার মৃত্যুর পর থেকেই আমার ভাই আনোয়ার পারভেজ রনি আমার মায়ের সাথে খারাপ আচরন করেই যাচ্ছে, একপর্যায়ে এতো বেশী খারাপ আচরন করে যে আমার মা ওই বাসা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। পরে আমার এক খালাতো ভাইয়ের বাসায় গিয়ে উঠে। 

সেখানে কিছুদিন পরে আমার নানার জমিতে ঘর তুলে সেখানেই আমার মা দীর্ঘ ৭ বছর ধরে একাকি মানবেতর ভাবে বসবাস করে আসছে। অপরদিকে আমার ভাই রনি বাবা-মাসহ আমার নিজ নামীয় সম্পত্তি থেকে আমাকেও বঞ্চিত করে নিজেই ভোগ দখল করে খাচ্ছে এবং আমাদের জমির বর্গাচাষীদের সাথে ফসলের ভাগ চাইতে গেলে তারাও আমার মাকে ফসলের ভাগ না দেয়ার পরিবর্তে বলে মায়ের সম্পত্তিতে ছেলে অধিকার বেশী একথা বলে ফসলের ভাগ না দিয়ে আমার মা কে বার বার ফিরিয়ে দেয়। অনেকবার আত্মিয়-স্বজন সহ এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তিদের মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করি কিন্তু তাতেও কোন কাজ হয়নি।

তিনি আরও বলেন, এবার আমাদের সকল সমস্যা সমুহ উল্লেখ করে ডোমার সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বরাবরে অভিযোগ দিয়েছি। আমরা আশাবাদী চেয়ারম্যান মহোদয়ের মাধ্যমে ন্যায় বিচার পাবো এবং আমাদের সব সম্পত্তির সমস্যা সমূহ সমাধান করে আমার মাকে পূর্বের অবস্থায় ফিরে যেতে তিনি কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহন করবেন।

এবিষয়ে খাদিজার একমাত্র ছেলে আনোয়ার পারভেজ রনির সাথে ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে নারাজ এবং একপর্যায়ে তিনি বলেন, আমার মা চেয়ারম্যানকে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছে, সালিশে দুপক্ষের উপস্থিতিতে তারা বিচার করবে কে দোষী আর কে নির্দোষ তখন প্রমান হবে।

এ ব্যাপারে ডোমার সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মাসুম আহমেদ বলেন, আমার পরিষদে খাদিজা খাতুন নামের এক বৃদ্ধার একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। ঘটনার সুষ্ঠু সমাধানের উদ্দেশ্যে খুব দ্রুত দুপক্ষের উপস্থিতিতে বসা হবে।

এমএসি/আরএইচ