জনবল সংকটে ধুকছে দেশের একমাত্র লাক্ষা গবেষণা কেন্দ্রটি

বৃহস্পতিবার ১৮ নভেম্বর ২০২১ ১৭:২৬


:: ফেরদৌস সিহানুক শান্ত, চাঁপাইনবাবগঞ্জঃ
 
প্রাচীন যুগ থেকেই বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য রপ্তানি পণ্য লাক্ষা। এর ব্যবহার বহুবিধ ও ব্যয়বহুল। তবে বর্তমানে হারিয়ে গেছে লাক্ষা চাষের সোনালী দিন। এক সময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সেমিয়লাটা, বরই, বাবলা, কড়ই গাছের বাগানে লাক্ষা চাষ করা হলেও নানা সংকটের মুখে পড়ে বরই গাছে এখনো লাক্ষা চাষ করছেনা চাষিরা।
 
তবে গবেষক সংকটের মধ্যে পড়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সম্ভাবনাময় লাক্ষা চাষাবাদ। এছাড়াও জনবল সংকটে ধুকছে দেশের একমাত্র লাক্ষা গবেষণা কেন্দ্রটি। খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে রয়েছে দেশের একমাত্র লাক্ষা গবেষণা কেন্দ্র চাঁঁপাইনবাবগঞ্জে। যদিও সেটি গবেষক- বিজ্ঞানীসহ জনবলের অভাবে চলছে ধুকে ধুকে। একাধিক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার পদ থাকলেও একজন মাত্র বিজ্ঞানীর পদায়ন দিয়ে চলছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের কল্যাণপুরে ২৪ একর জমির উপর লাক্ষা গবেষণা কেন্দ্র।
 
চাঁপাইনবাবগঞ্জ লাক্ষা গবেষণা কেন্দ্রের তথ্যমতে, দেশে বর্তমান লাক্ষার চাহিদা রয়েছে দশ হাজার মেট্রিক টন। কিন্তু বর্তমান চাঁপাইনবাবগঞ্জে উৎপাদন হচ্ছে দেড় থেকে দুই’শ মেট্রিক টন। এর ৭০ শতাংশ উৎপাদন হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জে। অবশিষ্ট লাক্ষা আমদানী করা হয় পার্শবতি দেশ ভারত থেকে।
 
লাক্ষা গবেষণা কেন্দ্রের তথ্যানুযাযী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের বরেন্দ্র অঞ্চল নাচোল উপজেলায় লাক্ষা চাষ বেশি হচ্ছে। তবে নতুন চাষী পাওয়া যাচ্ছে না। যারা চাষাবাদ করছেন, তারা মুলতঃ বাপ-দাদার অস্তিত্ব ধরে ধরে রাখতেই লাক্ষা চাষ করছেন।
 
নাচোল উপজেলার লাক্ষা চাষী সোলাইমান আলী জানান,তাঁরা বংশগতভাবেই লাক্ষা চাষ কওে আসছেন। প্রতি বছর ২৫-৩০ মন লাক্ষা উৎপাদন করতেন।কিন্তু আবহায়া অনুকূলে না থাকায়,লাক্ষা গবেষকদেও অবহেলা,নায্য মূল্য না পাওয়ার কারনে প্রায়ই বন্ধ কওে দেন লাক্ষা চাষ। তার পরেও গত দুই বছর থেকে ৫-৬মন লাক্ষা চাষ কওে আসছেন। তিনি আরও জানান,স্থানীয় লাক্ষা গবেষনা কেন্দ্র হতে যদি পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা পাওয়া যায়,তবে আবারও আগের মত লাক্ষার উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।
 
বর্তমানে প্রতি কেজি লাক্ষা ৬শ টাকা কেজি দ্বওে বিক্রি হচ্ছে।এসব লাক্ষা পাশের জেলা নওগাঁর ব্যবসায়ীরা বাড়ী হতেই কিনে নিয়ে যায়। শিবগঞ্জ উপজেলার এক সময়ে পুরাতন লাক্ষা চাষী তসিকুল ইসলাম জানান,প্রতি মৌসুমে তিনি ৫০-৬০ মন লাক্ষা চাষ করতেন।দিন দিন আবহাওয়ার বিরুপ প্রভাব। আম বাগানে অতিরিক্ত কীটনাশক প্রয়োগের ফলে লাক্ষা চাষ প্রায় শুণ্যেও কোঠায় উঠে আসে।এছাড়া স্থানীয় কৃষিবিভাগ এবং লাক্ষা গবেষকদেরও কোন সহযোগিতা পাওয়া যায়নি।
 
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ লাক্ষা গবেষণা কেন্দ্রের প্রিন্সিপ্যাল সাইন্টিফিক অফিসার মো. মোখলেসুর রহমান জানান,লাক্ষা একটি লাভজনক ফসল। আবহাওয়াগত কারণে চাঁপাইনবাবগঞ্জে লাক্ষা চাষের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর ও শিবগঞ্জ উপজেলায় আম চাষ উত্তর-উত্তর বেড়ে যাওয়ার কারণে জেলার উচুঅঞ্চল বরেন্দ্র এলাকায় লাক্ষা চাষের চাহিদা বৃদ্ধি পেলেও প্রতিনিয়ত লাক্ষার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে চাষিরা। এ ছাড়া লাক্ষার চাষ বাড়াতে আমাদের কোন গাফেলতি নেই।
 
ব্যবহার: লাক্ষার আছে বহুবিধ ব্যবহার। কাঠের আসবাব বার্নিশ করা এবং বিভিন্ন ধরনের পেইন্ট তৈরির কাজে ব্যবহূত হয়। অস্ত্র ও রেলওয়ে কারখানায়, বৈদ্যুতিক শিল্প-কারখানায় অপরিবাহী বার্নিশ পদার্থ হিসেবে, ডাকঘরের চিঠি, পার্সেল ইত্যাদি সিলমোহর করার কাজে, চামড়া রং করা ও স্বর্ণালংকারের ফাঁপা অংশ পূরণে লাক্ষা ব্যবহূত হয়।
 
লাক্ষা গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোখলেসুর রহমান জানালেন, সাম্প্রতিককালে ওষুধশিল্পের ক্যাপসুলের আবরণ হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। লেবুজাতীয় ফলের সংরক্ষণ গুণ বাড়ানোর জন্য আবরণ হিসেবে, চুইংগাম ও চকলেটের আবরণ হিসেবেও এর ব্যবহার রয়েছে।
 
বিপণন: ডাল থেকে ছাড়ানো কাঁচা লাক্ষা ভালোভাবে পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করে শুকিয়ে দানা লাক্ষা তৈরি করা হয়। এই দানা লাক্ষাকে কাপড়ের তৈরি পাইপের মধ্যে ঢুকিয়ে আগুনে তাপ দিয়ে বানানো হয় টিকিয়া। এ টিকিয়া বিক্রি হয় বাজারে। কাঁচা লাক্ষা থেকে টিকিয়া প্রক্রিয়াজাতকরণের কারখানা রয়েছে রাজশাহী ও নাচোলে। কারখানার মালিকেরা চাষিদের কাছ থেকে কাঁচা লাক্ষা কিনে নেন।
 

এমএসি/আরএইচ