চাঁপাইনবাবগঞ্জে টিউমারের অভিনব চিকিৎসায় সাফল্য, ২৪ ঘন্টায় সুস্থতা 

রবিবার ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৮:৩১


:: ফেরদৌস সিহানুক শান্ত, চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি ::
 
 
মাত্র ২৪ ঘন্টার ব্যবধানে উধাও টিউমার! স্বল্প খরচে, মাত্র একদিনে, কোন কাটাছেঁড়া ছাড়াই টিউমার চিকিৎসায় সাফল্য দেখিয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক যুবক। বিভিন্ন ভেষজ গাছের মূল ব্যবহার করে দেয়া এই অভিনব চিকিৎসায় ইতোমধ্যে কয়েকশ টিউমার রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েছেন। চিকিৎসায় সফলতার হারও শতভাগ। এই সাফল্যের খবর ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। বাবার উদ্ভাবন এই ভেষজ চিকিৎসায় প্রশংসা কুড়িয়েছেন গোমস্তাপুর উপজেলার আলীনগর ইউনিয়নের ইমামনগর গ্রামের নিহত আব্দুস সাত্তারের ছেলে মো. রাকিব হাসান বাবু (২৭)। 
 
অপারেশনের বিপরীতে বিভিন্ন গাছের মূল দিয়ে এই চিকিৎসা করা হয়। প্রথমদিনে গাছের মূল দিয়ে তৈরি পেস্ট লাগানো হয় টিউমার হওয়া জায়গায়। ২৪ ঘন্টা পর টিউমারের মুখ দিয়ে বের করে নেয়া হয় সমস্ত দূষিত রক্ত ও পুঁজ। এতে কোন ব্যথা পায় না টিউমারের রোগী। এছাড়াও কাটা ছেড়া না থাকায় ঝুঁকিও অনেকাংশে কম। এমনকি চিকিৎসা নেয়ার পর সেই স্থানে টিউমার হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে৷ তাই জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে এসে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হচ্ছেন অনেকেই। 
 
সুস্থ হওয়া টিউমার রোগী, স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গোমস্তাপুর উপজেলার আলীনগর ইউনিয়নের ইমামনগর গ্রামের নিহত আব্দুস সাত্তার প্রায় ২০ বছর আগে এই চিকিৎসা ব্যবস্থার জনক। এরপর তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেঁচে থাকা অবস্থায় দীর্ঘদিন ধরে এই চিকিৎসা দিয়েছেন। পরে তিনি মারা গেলে তার ছেলে রাকিব হাসান বাবু গত ৮ বছর ধরে এই চিকিৎসা করছেন৷ বাবু পেশাদার কোন চিকিৎসক নয়, বাবার হাতে শিখে এই কাজ করছেন বলে জানান তারা। 
 
রাকিব হাসান বাবুর কাছে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন, আলীনগর ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা মো. মুশফিকুর রহমান নয়ন। তিনি বলেন, একটু একটু করে বড় হতে হতে অনেক বিশালাকৃতি ধারন করে আমার ডান কানের নিচে একটি টিউমার হয়। ৩ বছরের এই টিউমারের চিকিৎসা করাতেও ভয় লাগছিল। হঠাৎ গত ৩-৪ মাস আগে বাবুর সাথে দেখা হলে, সে জানায় এটির চিকিৎসা করতে পারবে। এরপর তার উপর ভরসা রেখে গাছ লাগানোর ২৪ ঘন্টা পরে নিজ হাতে টিউমারের জায়গাটি টিপে টিপে ওয়াশ করে দেয়। আলহামদুলিল্লাহ, এভাবেই ভেষজ চিকিৎসায় টিউমার থেকে আমি এখন পুরোপুরি সুস্থ৷ নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি স্যতি, টিউমারের চিকিৎসায় সে একজন ওস্তাদ। 
 
রহনপুর নূনগোলা এলাকার আম ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম (৫০) জানান, গত ২ বছর ধরে আমার দেহে টিউমার ছিল। একবার অপারেশন করেছিলাম। কিন্তু একই জায়গায় আবারও টিউমার হয়। এবারও অপারেশন করার জন্য সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিলাম। পরে এক পরিচিত ব্যক্তির মাধ্যমে রাকিব হাসান বাবুর খোঁজ পায়। এরপর টিউমারের জায়গায় ওষুধ লাগিয়ে আধাঘন্টা রাখার পর তুলে নেয়। 
 
রফিকুল আরও জানান, পরের দিন টিউমারের জায়গাটি পেঁকে গেলে হাত দিয়েই চেপে সমস্ত রক্ত ও পুঁজ বের করে রাকিব হাসান বাবু। গত ৭ দিন আগের ঘটনা এটি। আমি এখন মোটামুটি সুস্থ। টিউমারের জায়গাটিও শুকিয়ে গেছে। প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থার ব্যতিক্রম এই চিকিৎসা অনেক ভালো। এমনকি খরচও কম। কাটাছেঁড়ার মধ্যে যাবো না বলেই এমন চিকিৎসা গ্রহন করেছেন বলেও  জানান তিনি।
 
নাচোলের ইসমাইল হোসেন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে টিউমার নিয়ে খুব সমস্যায় ছিলাম। পরে বাবুর খোঁজ পেলে চিকিৎসা করালে সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হয়েছি। খুব ভালো ও একটি সহজ চিকিৎসা ব্যবস্থা। বিভিন্ন গাছের মূল দিয়ে তৈরি পেস্ট লাগানোর পর পরের দিন খুব সহজেই টিউমারের ভেতরে থাকা সকল রক্ত ও পুঁজ বের করা হয়। এখন পুরোপুরি সুস্থ হয়েছি। প্রচলিত চিকিৎসায় অপারেশনের ঝামেলা এড়িয়ে এখানে খুব সহজেই টিউমার ভালো হয়ে যায়। 
 
রাকিব হাসান বাবু বলেন, আমি কোন ডাক্তার নয়। এমনকি চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে আমার কোন প্রশিক্ষণ বা অভিজ্ঞতা নেই। বাবার থেকে শেখার পর তার মৃত্যু হলে তখন থেকে এই কাজ করছি। এখন পর্যন্ত অসংখ্য টিউমার রোগীর চিকিৎসা করেছি। আল্লাহর রহমতে সবাই সুস্থ হয়েছেন। এই চিকিৎসা নিতে গিয়ে গরিব অসহায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষকে বিনামূল্যে সহায়তা করি। 
 
গোমস্তাপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন বুলবুল জানান, বাবুর বাবা এলাকায় দীর্ঘদিন এটা করেছিলেন। তার মৃত্যুর পর ছেলে বাবু এটা করছে। টিউমারের জন্য ভালো একটি ব্যবস্থা এটি। এই চিকিৎসা ব্যবস্থা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে অনেক মানুষের উপকার হবে। 
 
যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের চাঁপাইনবাবগঞ্জ যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ডেপুটি কো-অর্ডিনেটর মো. সারোয়ার হোসেন তার নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে বাবুর টিউমার চিকিৎসা করার একটি ভিডিও আপলোড করেছেন। তিনি বলেন, একজনের টিউমার চিকিৎসা করা অবস্থায় আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। অভিনব চিকিৎসাটির পুরো ভিডিও মুঠোফোনে ধারণ করি। পরে আমার ইউটিউব চ্যানেলে তা আপলোড করি, যাতে তা দেখে অনেকেই উপকার পায়। 
 
যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, টিউমার যেকোন বয়সের, যেকোন মানুষকে হতে পারে। এধরনের চিকিৎসা আমি এর আগে কখনও দেখিনি। অল্প খরচে, কম সময়ে কার্যকরী একটি চিকিৎসা ব্যবস্থা এটি। দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য এই চিকিৎসা খুবই উপকারী হবে। কারন আমাদের দেশে এখনও অনেক খেটে-খাওয়া অসহায় মানুষ রয়েছে, যারা অর্থাভাবে প্রাইভেট ক্লিনিকে ব্যয়বহুল খরচে অপারেশন করতে পারে না। বাবুর এই চিকিৎসা ব্যবস্থা দীর্ঘমেয়াদী হলে টিউমারের চিকিৎসায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে।
 
চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায়, টিউমার হচ্ছে— কিছু অস্বাভাবিক টিস্যুর সমাবেশ, যেখানে কোষগুলো অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সংখ্যা বাড়ায়। টিস্যু মানে একই ধরনের কিছু কোষ, যখন কোথাও এক হয়ে একই ধরনের কাজ করে। মানবদেহে বিলিয়ন নয়, ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন কোষ আছে। ধরা হয়, একজন প্রাপ্তবয়স্কের দেহে গড়ে ৩০ ট্রিলিয়নের মতো কোষ থাকে। কোষের ভেতর কিছু নিয়মে পুরনো কোষ মরে যায়, নতুন কোষ জন্ম নেয়, আবার কিছু কোষ আকারে বাড়ে, কিছু কোষ সংখ্যায় বাড়ে। 
 
কোনো কারণে ডিএনএর মধ্যে থাকা এ নির্দেশ প্রক্রিয়া পরিবর্তন হয়ে গেলে কোষগুলো তখন অস্বাভাবিকভাবে নতুন কোষের জন্ম দিতে থাকে, পুরনো কোষ মরে না গিয়ে হযবরল ঘুরতে থাকে, অথবা নতুন জন্ম নেওয়া কোষগুলো কাজবিহীন ঘুরে বেড়ায়। কারণ কোষগুলোতে কোথায় গিয়ে থামতে হবে তার নির্দেশ থাকে না, কী কাজ করবে তার নির্দেশটি পরিবর্তন হয়ে যায়। তখন শরীরের অতিরিক্ত এবং অস্বাভাবিক এ কোষগুলো কোথাও জমা হয়ে একটি লাম্প বা প্লি বা চাকতির মতো হয়ে প্রকাশ পেলে তাকে তখন টিউমার বলে। উল্লেখ্য, জার্মান ব্রেন টিউমার এসোসিয়েশনের তথ্য মতে, বিশ্বব্যাপী দৈনিক ৫০০০ মানুষের দেহে টিউমার ধরা পড়ে ৷ 
 
 
 

এমএসি/আরএইচ