চাঁপাইনবাবগঞ্জের গ্রাহকের ৩ কোটি টাকা নিয়ে মালিক উধাও, ৮দিন ধরে অবরুদ্ধ দুই কর্মী  

মঙ্গলবার ১৯ অক্টোবর ২০২১ ১৯:৩১


ফেরদৌস সিহানুক শান্ত, চাঁপাইনবাবগঞ্জঃ
 
চাঁপাইনবাবগঞ্জে একটি এনজিও মালিক গ্রাহকের প্রায় তিন কোটি টাকা নিয়ে আত্নগোপন করেছেন। এনজিও লাপাত্তা হওয়ার শঙ্কায় গ্রাহকরা এনজিও-টির দুই কর্মীকে গত ৮দিন ধরে একটি অফিস কক্ষে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। গত সপ্তাহের সোমবার (১১ অক্টোবর) যমুনা মানব কল্যান সংস্থা নামক একটি ভুয়া এনজিও গ্রাহকের টাকা নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার শঙ্কায় ৬ শতাধিক গ্রাহক চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার চককীর্তি ইউনিয়নের চাতরা নতুন বাজার মোড় শাখায় জমায়েত হয়ে বিক্ষোভ করেছেন। এসময় ওই এনজিও টির ২ কর্মীকে অবরুদ্ধ করে রাখে। 
 
গ্রাহক, এনজিও কর্মী ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, যমুনা মানব কল্যান সংস্থার চাতরা শাখায় প্রায় এক হাজার গ্রাহকের ২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা বিভিন্ন মেয়াদে জমা রয়েছে। এর বিপরীতে এই শাখায় ঋণ ছাড়া আছে ১৭ লাখ টাকা। দীর্ঘদিন ধরে গ্রাহকরা তাদেরকে জমা করা টাকা ফেরত চাইলেও বিভিন্ন টালবাহানা শুরু করে এনজিও-র মালিক। এর জের ধরেই সোমবার (১১ অক্টোবর) অন্তত ৬ শতাধিক গ্রাহক তাদের পাওনা টাকার জন্য বিক্ষোভ করতে থাকে। 
 
সংশ্লিষ্টরা জানায়, মাইক্রো ক্রেডিট অথরিটি-এমআরএ'র নিবন্ধন না থাকলেও আইন অমান্য করে স্থানীয়ভাবে সমাজ সেবা, মহিলা সংস্থা ও যুব উন্নয়ন থেকে অনুমোদন প্রাপ্ত হয়ে ১৬টি শাখার মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন করছিল যমুনা মানব কল্যান সংস্থা নামের এই এনজিও। গত ৬ মাসের মধ্যে ধাইনগর, চৌডালাসহ ৪টি শাখা বন্ধ হয়ে গেলে চাতরা নতুন বাজারের শাখায় ভিড় করতে থাকে গ্রাহকরা। রবিবার (১০ অক্টোবর) রাতে কয়েকজন গ্রাহক চাতরা শাখাটিও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে জানতে পেরে এনজিও-র' এরিয়া ম্যানেজার কবির হোসেন ও চাতরা শাখা ব্যবস্থাপক সেলিম রেজাকে শাখা কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখে। 
 
সোমবার (১৮ অক্টোবর) চাতরা শাখায় গেলে দেখা যায়, দুই কর্মী কবির হোসেন ও সেলিম রেজা এখনও অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। মাঝেমধ্যে তাদের স্বজনরা এসে দেখা করে যাচ্ছে। বাড়ি থেকে আত্মীয় স্বজনরা খাবার দিয়ে যাচ্ছে। তাদের কাছ থেকে মুঠোফোন নিয়ে নেয়া হয়েছে। গত ৮ দিন ধরে এই অফিসের মধ্যেই থাকা খাওয়া করছেন তারা। তাদের পাহারা দিচ্ছেন গ্রাহকদের লোকজন৷ জানা গেছে, দুই কর্মীকে আটকের পর জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলেও স্থানীয় জনতা তাদেরকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে অস্বীকার জানান। পরে পুলিশ স্থানীয় ব্যবসায়ী ও এনজিওর গ্রাহক মানু মিয়াকে দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে চলে আসে। 
 
যমুনা মানব কল্যান সংস্থায় ২০ লাখ টাকা জমা রেখেছেন স্থানীয় বাসিন্দা মনোয়ার হোসেন মানু মিয়া। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে টাকা দিতে অস্বীকার করে আসছে। দিবো দিচ্ছি করে সময় পার করছে। কয়েকদিন আগে তাদের আরও কয়েকটি শাখা বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবর পেলে গ্রাহকরা দুই কর্মীকে শিবগঞ্জ উপজেলার মোবারকপুর ইউনিয়নের ত্রিমোহনী বাজার থেকে তাদেরকে আটক করে চাতরা শাখায় নিয়ে আসে। তারপর থেকে তাদেরকে এখানেই আটক করে রাখা হয়েছে। 
 
আরেক গ্রাহক আব্দুর রাকিব জানান, সোমবার (১১ অক্টোবর) গ্রাহকদের বিক্ষোভের ঘটনার কয়েকদিন আগে থেকেই যমুনা মানব কল্যান সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মো. মঈন আলী পলাতক রয়েছে। তার কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। বিক্ষুব্ধ গ্রাহকদের অবস্থা এমন যে, তাকে পেলে মেরে ফেলবে। কারন অনেক অসহায় মানুষ তাদের জমানো সব টাকা সেখানে কিছু লাভের আশায় জমা রেখেছিল। 
 
হাসেম মিঞা জানান, তার ভগ্নিপতি মারা যাওয়ার পর বোন হাজেরা বেগম সংসারের খরচ চালাতে এবং নিজের চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে জমি বিক্রির ৮ লাখ টাকা যমুনার চাতরা শাখায় রেখে লাভের টাকায় সংসার চালাতেন। কিন্তু ৬ মাস থেকে তিনি লাভ তো দূরের কথা মূল টাকাও পাচ্ছেননা। উল্টো তাদের বিভিন্নভাবে ভয় ভীতি দেখানো হচ্ছে।
 
অবরুদ্ধ দুই এনজিও কর্মীর দেখভালের দায়িত্বে থাকা এক যুবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, গত ৮ দিনের মধ্যে দুইবার লোকজন এসেছিলো তাদেরকে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে৷ কিন্তু আমরা সবসময় সর্তক থাকায় তাদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। যতদিন পর্যন্ত টাকা না পাবো, ততদিন তাদেরকে ছাড়া হবে না। আমরা এখন মালিককে খুঁজছি। 
 
এবিষয়ে অবরুদ্ধ এরিয়া ম্যানেজার কবির আলী বলেন, এর আগেও ৭-৮ মাস আগে এনজিও মালিক মঈন আলীকে তারা (গ্রাহক) আটক করেছিল। পরে মালিক ১৮ মাসের সময় নিয়েছিল গ্রাহকের টাকা পরিশোধ করতে। কিন্তু সেসময়ের প্রথম কিস্তি পরিশোধ না করায় এবং কয়েকটি শাখা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গ্রাহকেরা আমাদের দুইজনকে আটক করে রেখেছে। 
 
অবরুদ্ধ আরেক কর্মী সেলিম রেজা জানান, আমাদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে নিয়েছে। তাই মালিক বা সংশ্লিষ্ট কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না। কি হচ্ছে আর কি হবে কিছুই জানি না। কারন মালিকের কোন হদিস মিলছে না। এই এক ঘরেই বন্দী অবস্থায় আছি গত ৮ দিন ধরে। 
 
সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মঈন আলীর সাথে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। শিবগঞ্জ থানার অফিসার-ইন-চার্জ (ওসি) ফরিদ হোসেন জানান, ঘটনার দিন (১১ অক্টোবর) পুলিশ উপস্থিত হলে জানতে পারে গ্রাহকরা টাকা পাবে, তাই তারা দুই কর্মীকে আটকে রেখেছে। সোমবার (১৮ অক্টোবর) বিকেল ৫টা পর্যন্ত এবিষয়ে থানায় কোন লিখিত অভিযোগ পাওয়া যায়নি। অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। 
 
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাকিব-আল-রাব্বী বলেন, যমুনা মানব কল্যাণ সংস্থা নামে কোন নিবন্ধিত এনজিও নাই। তাই তারা গ্রাহকের টাকা নিয়ে পালিয়ে গেলে আমাদের করনীয় তেমন কিছু নেই। এমনকি এসব ভুয়া ও অনিবন্ধিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে লেনদেন না করতে জনসাধারণকে সচেতন করতে উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে মাইকিং করা হয়েছে। 
 
অনিবন্ধিত এনজিও যমুনা মানব কল্যাণ সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মঈন আলীকে খুঁজে বের করে পাওনা টাকা ফিরে পেতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন গ্রাহকেরা। উল্লেখ্য, একই এলাকার কুসুমকলি, মার্সাল, রূপালীসহ কয়েকটি এনজিও গ্রাহকের কয়েক কোটি টাকা আত্মসাত করে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। 
 

এমএসি/আরএইচ