ক্যারিয়ারের পর্যাপ্ত সময় টাইগার দলে সুযোগ পাননি শিবলু

শনিবার ১৪ মে ২০২২ ২০:০৮


:: এস এম হাবিবুল হাসান, সাতক্ষীরা ::
 
‘যদি লক্ষ্য থাকে অটুট, বিশ্বাস হৃদয়ে, হবেই হবেই দেখা, দেখা হবে বিজয়ের। কিন্তু  সেই লক্ষ্যও কখনও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যায়। তেমনি হয়েছিল দেশসেরা সাবেক টাইগার পেসার শেখ রবিউল ইসলাম শিবলু’র বেলায়। যে কিনা ক্যারিয়ারের সেরা ফর্মে থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত সময় টাইগার দলে সুযোগ পাননি। তৎকালিন সময়ে বাংলাদেশ দলের দায়িত্বে থাকা হেড কোচ হাথুরুসিংহ ফিটনেস সমস্যা, বলে গতি কমসহ নানা অজুহাতে তাকে দলে সুযোগ দেওয়া হতো না বলে অভিযোগ পেসার শিবলুর। তবে তৎকালিন আরেক বাংলাদেশ দলের হেড কোচ শেন জার্গেসন হতাশা প্রকাশ করে বলেছিলেন, 'তাকে (শিবলু) বাংলাদেশ দলে না খেলানোটা সত্যিই লজ্জাকর।

২০১৩ থেকে ২০২১ সাল, সময়ের হিসেবে ৮ বছর। অবাক করা হলেও সত্য যে, ৮ বছরের ঐ সময়ে বাংলাদেশি কোন পেসার টেস্টে এক ইনিংসে ৫ উইকেট নিতে পারেননি। সর্বশেষ ২০১৩ সালের এপ্রিলে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম ও দ্বিতীয় টেস্টে যথাক্রমে ৬ ও ৫ উইকেট নিয়েছিলেন টাইগার পেসার রবিউল ইসলাম শিবলু। হারিয়ে যাওয়া এই টাইগার পেসারের আক্ষেপ, ক্যারিয়ারে পর্যাপ্ত সুযোগ পাননি। আক্ষেপের ক্যারিয়ার ঘুচিয়ে আম্পায়ার ও ক্রিকেট কোচ হওয়ার স্বপ্নে বিভোর শিবলু। গত ২০১৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি শিবলু সব ধরনের ক্রিকেট থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর নিয়েছেন। যদি ফিটনেস ধরে রাখতে পারে তবে স্থানীয় লীগে খেলতে পারে বলে জানান শিবলু। দীর্ঘ ৮ বছর পর শিবলুর রেকর্ড ভাঙ্গে চলতি বছরের ৫ জানুয়ারিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্টে সাত উইকেট নিয়ে ম্যাচ সেরা হয়ে টাইগার বোলার এবাদত হোসেন চৌধুরী। তারমধ্যে তার প্রথম ইনিংসে ১ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ৬ উইকেট শিকার করেন এবাদত।

জিম্বাবুয়ে সিরিজে সেই সময়ের শিবলুর বোলিং দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন তৎকালিন বাংলাদেশ দলের হেড কোচ শেন জার্গেসন। শিবলুকে নিয়মিত সুযোগ না দেওয়ায় হতাশ জার্গেসন বলেছেন, 'তাকে (শিবলু) না খেলানোটা সত্যিই লজ্জাকর। আমার যতদূর মনে পড়ে জিম্বাবুয়ে সিরিজের পর সে কিছুটা ইনজুরি এবং ফিটনেস সমস্যায় ভুগছিল।’

তিনি আরও বলেছেন, ‘ঘরের মাঠের কন্ডিশনের সাথে তাকে মানিয়ে নিতে পর্যাপ্ত সুযোগ দেওয়া হয়নি। তার বোলিংয়ের সাথে জিম্বাবুয়ে, নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ডের কন্ডিশন ভালো মানায়। কিন্তু বাংলাদেশের কন্ডিশনের সাথে মানিয়ে নেওয়ার মতো পর্যাপ্ত সময় তাকে দেওয়া হয়নি।’

কোচের মতো হতাশ শিবলুর কণ্ঠেও। তার বিশ্বাস পর্যাপ্ত সুযোগ দেওয়া হলে আরও ভালো করতেন। শিবলু বলেন, ‘জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সেই সিরিজটা আমার সেরা সিরিজ। হারারের কন্ডিশনে আমি বল করে খুব মজা পাচ্ছিলাম।’

টাইগার পেসার শিবলু ১৯৮৬ সালের ২০ ফেব্রয়ারী  শেখ নুরুল ইসলাম ও আসমা খাতুন দম্পত্তির কোল আলো করে পৃথিবীতে আসে। সাতক্ষীরা জেলা শহরের মুনজিতপুর গ্রামে জন্মগ্রহণকারী বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার শিবলু ছাড়াও তার এক বোন রয়েছে। পিতার মৃত্যুর পর তাকেই সংসারের হাল ধরতে হয়েছে। একমাত্র বোনের বিয়ে হলেও এখনও শিবলু বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়নি। গ্রামীণফোন পেসার হ্যান্ডের মাধ্যমে তৎকালীন কোচ সালাউদ্দীনের নজরে পড়ে শিবলু। তখন তার বোলিংয়ের গড় গতি ছিল ঘন্টায় ১৩০ - ১৪০ পর্যন্ত। তারপরেই তার জাতীয় দলে ডাক পাওয়া।

শিবলু ডানহাতি ফাস্ট মিডিয়াম বোলার হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে ক্রিকেট খেলেছিলেন। এছাড়াও, তিনি ডানহাতি ব্যাটসম্যানরূপে পরিচিত। ৩ মে, ২০১৩ সালে একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অভিষিক্ত হয় তার। ঘরোয়া ক্রিকেট লীগে খুলনা বিভাগীয় ক্রিকেট দলের হয়ে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে অংশগ্রহণ করছেন।

এর আগে,  ২০১০ সালের ২৭ মে ইংল্যান্ড সফরে লর্ডসে তার প্রথম টেস্ট অভিষেক হয়। প্রথম টেস্টে কোন উইকেট না নিলেও, তার বোলিংয়ের সহায়তায় একটি রান আউট হয়েছিল। পরের টেস্টের জন্য তাকে দলে নেওয়া হয়নি।

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জুলাই, ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত একমাত্র টেস্টে অংশ নেন শিবলু। দীর্ঘ ছয় বছরের স্বেচ্ছা নির্বাসন থেকে টেস্ট ক্রিকেটে ফিরে আসে জিম্বাবুয়ে । অন্যদিকে বাংলাদেশ দলটি চৌদ্দ মাসেরও অধিক সময় কোন টেস্ট খেলেনি। কিন্তু প্রত্যাশা করা হয়েছিল যে, বাংলাদেশ বিজয়ী হবে। কিন্তু এ ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়, যখন বাংলাদেশ টেস্টটিতে মাত্র ১৫ রানের ব্যবধানে হেরে যায়। শফিউল ইসলামের সাথে শুরুতেই বোলিং করতে এসে তিন উইকেট লাভ করেন শিবলু। হ্যামিল্টন মাসাকাদজাকে ইমরুল কায়েসের ক্যাচে পরিণত করে প্রথম উইকেট শিকার করেন পেসার শিবলু।

টাইগার ক্রিকেটার রবিউল ইসলাম শিবলু ২০১০ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে জাতীয় ক্রিকেট দলের নিয়মিত খেলোয়াড় ছিলেন। জাতীয় দলের হয়ে ৯টি টেস্ট, ৩টি একদিনের এবং একটি টি-টৌয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন। ৯ টেস্টে তার শিকার ২৫ উইকেট। ৩ ওয়ানডে খেলে নিয়েছেন ২ উইকেট। ১টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেললেও কোনো উইকেট নেই তার। জিম্বাবুয়ের সফরের টেস্ট সিরিজের ১৫টি উইকেট শিকার করে ম্যান অব দ্য সিরিজ নির্বাচিত হয়েছিলেন। যা দেশের বাইরে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একটি অনন্য রেকর্ড। সেবছর অক্টোবরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে কোচ স্টুয়ার্ট ল তাকে বাদ দেন।

জিম্বাবুয়ে সিরিজে ভালো করার পরও নিয়মিত দলে সুযোগ পাননি শিবলু। শেন জার্গেসনের বিদায়ের পর বাংলাদেশ দলের দায়িত্ব নেন হাথুরুসিংহে। নতুন কোচ দলের আসার পর থেকেই খারাপ সময় শুরু শিবলুর। ফিটনেস সমস্যা, বলে গতি কমসহ নানা অজুহাতে তাকে সুযোগ দেওয়া হতো না বলে অভিযোগ শিবলুর।

গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শিবলু বলেন, ‘নির্বাচকরা আমাকে বলেছিল যে, নতুন কোচ হাথুরুসিংহে আমাকে দলে নিতে আগ্রহী না। তারা আমাকে টেস্ট ফরম্যাটের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলেন।’

ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর শেষে দেশে ফেরার পথে কোচ হাথুরুসিংহকে শিবলু একটি প্রশ্ন করছিলেন, সেই প্রশ্নের কোন সু-উত্তর দিতে পারেননি কোচ। সেই স্মৃতি স্মরণ করে শিবলু বলেন, ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর শেষ করে দেশের ফেরার সময় কোচ আমাকে বলে যে, আমার গতি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সাথে মানানসই নয়। আমি তাকে তখন জিজ্ঞেস করি কোনটা ভালো, কোনো সুইং ছাড়া ১৪০ কি.মি গতিতে বল করা নাকি সুইং-সহ নিয়মিত ১৩৩-১৩৫ কি.মি গতিতে বল করা? কোচ এর কোন সু-উত্তর আমাকে দিতে পারেনি।’

তার প্রতি যে অবিচার করা হয়েছে তার উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘আগের সিরিজের সিরিজ সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হওয়ার পরেও আমাকে পরের সিরিজে সুযোগ দেওয়া হয়নি। আমাকে বলা হলো যে, আমার ফিটনেস সমস্যা। যদিও আমি ট্যুর ম্যাচে ১৫ ওভার বল করেছিলাম।

টেস্ট দলে শিবলুকে না দেখে অবাক হয়েছিলেন জিম্বাবুয়ের খেলোয়াড়েরাও। ফতুল্লায় অনুষ্ঠিত সেই ম্যাচের স্মৃতিচারণ করে শিবলু বলেন, ‘এমনকি জিম্বাবুয়ের কিছু খেলোয়াড়ও আমাকে জিজ্ঞেস করে আমি কেনো টেস্ট দলে নেই। আমি তাদের কী উত্তর দিব নিজেও জানতাম না। তাদের বলি যে, কোচ আমাকে বলেছে আমি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার মতো ফিট নই।’

দুর্ভাগ্য হউক কিংবা ফিটনেসের সমস্যাই হউক, ক্রিকেটার হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার বড় করতে ব্যর্থ হওয়া রবিউল ইসলাম শিবলু এখন স্বপ্ন দেখছেন আম্পায়ার হওয়ায়। ইতিমধ্যেই তিনি আম্পায়ারিংয়ের উপর কোচিং এবং কোচিং কোচ সম্পন্ন করেছেন।

নিজের শেষ ইচ্ছে সম্পর্কে শিবলু বলেন, ‘আমি আম্পায়ারিং সম্পর্কে আরও শিখছি। যদিও কোভিডের কারণে প্র্যাকটিকালি শুরু করতে পারেনি। মনি ভাই (এনামুল হক মনি) আমাকে এই প্রফেশনে আসার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন।’এছাড়া শিবলুকে বিসিবি থেকে খুলনা বিভাগীয় ক্রিকেট দলের সহকারি কোচের দ্বায়িত্ব দিয়েছেন। তাছাড়া শিবলু সাতক্ষীরা জেলা ক্রিকেট দলের কোচ হিসাবে দ্বায়িত্ব পালন করছেন।

সম্প্রতি যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেল জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক টাইগার খেলোয়াড় শেখ রবিউল ইসলাম শিবলু’র পাশে দাঁড়িয়েছেন। তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ নাক ও নাভীর পীড়াসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। এছাড়া তার বৃদ্ধ মাতা আসমা খাতুনও অসুস্থ্য। এ অবস্থায় সাবেক এ ক্রিকেটারের বঙ্গবন্ধু ক্রীড়াসেবী কল্যাণ ফাউন্ডেশন থেকে দুই লাখ টাকার আর্থিক অনুদান দেওয়া হয়।

এমএসি/আরএইচ