কমলগঞ্জে মনিপুরীদের ১৭৯তম মহা রাসলীলা উৎসব সমাপ্ত

শনিবার ২০ নভেম্বর ২০২১ ১৭:৫৪


:: আমিনুল ইসলাম (হিমেল), কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি ::


ঢাক, ঢোল, মৃদঙ্গ, করতাল এবং শঙ্খ ধ্বনির সঙ্গে ব্যাপক আনন্দ উল্লাস ও কঠোর নিরাপত্তার মধ্যদিয়ে রাধা-কৃষ্ণের লীলাকে ঘিরে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে মণিপুরি সম্প্রদায়রে প্রধান ধর্মীয় উৎসব শনিবার রাসলীলা শেষ হয়েছে।

এই উৎসবটি মণিপুরি সম্প্রদায়রে হলেও এখন আর তা কেবল মণিপুরিরাই নয়, স্থানীয় বাঙালসিহ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অন্যান্য সব সম্প্রদায়রে লোকজনের অংশগ্রহণইে উদযাপিত হয়।

শুক্রবার ১৯ নভেম্বর দুপুর ১২টা থেকে রাখাল নৃত্যের মাধ্যমে উপজেলার মাধবপুর জোড়ামণ্ডপ এবং আদমপুর মণিপুরি কমপ্লেক্স ও জোড়ামন্ডপে রাস উৎসব ও রাসমলো শুরু হয়েছে। গোপরাস বা রাখুয়ালের মাধ্যমে এই উৎবের শুভ সুচনা হয়। রাত ১২টা থেকে শুরু হবে ঐতিহ্যবাসী রাসনৃত্য। মহারাত্রির আনন্দের পরশ পেতে আসা দেশের বিভিন্ন স্থান হাজার হাজার নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোরসহ নানা পেশার মানুষের পদচারণায় শুক্রবার সকাল থেকে মুখরিত হয়ে উঠে মণিপুরি পল্লীর এ দুটি এলাকা।

শনিবার ঊষালগ্নে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে অনুষ্ঠানের পরিসমাপ্তি ঘটে। কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর জোড়া মন্ডপ প্রাঙ্গনে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সম্প্রদায়ের ১৭৯তম ও আদমপুরের মণিপুরি কালচারাল কমপ্লেক্স প্রাঙ্গণে মণিপুরি মী-তৈ সম্প্রদায়ের ৩৬তম এবং নয়াপত্তন যাদু ঠাকুর মন্ডপ প্রাঙ্গণে ৬ষ্ঠ বারের মতো মহারাসোৎসব শুরু হয়েছে।

বর্ণাঢ্য আয়োজনে রাস উৎসবে প্রতিবারের মত এবারও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। উৎসব উপলক্ষে বসেছে রকমারি আয়োজনে বিশাল মেলা। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার ভক্তবৃন্দসহ দেশী-বিদেশী পর্যটকের ভিড়ে মুখরিত হয়ে ওঠে কমলগঞ্জের মণিপুরি অঞ্চলগুলো। ভিড় সামলাতে আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হিমশিম খেতে দেখা যায়।

রাসলীলা উপলক্ষে কমলগঞ্জের তিনটি স্থানে মেলার আয়োজন করা হয়েছে। মেলায় খৈ, মুড়ি, বাতাসা, ছোটদের বিভিন্ন ধরনের খেলনা, পোশাক-পরিচ্ছদ, ঘর সাজানোর বিভিন্ন উপকরণ ও প্রসাধনী, শ্রীকৃষ্ণের ছোট-বড় বিভিন্ন আকৃতির ছবিসহ বাহারি পণ্য শোভা পাচ্ছে। এ ছাড়া মাধবপুর শিববাজার এলাকায় মেলা প্রাঙ্গণে বসেছে মণিপুরি সম্প্রদায়ের ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে বইপত্রের কয়েকটি স্টল।

মূল রাসলীলা রাত ১২টা থেকে শুরু হয়ে শনিবার ভোর পর্যবে। বাঁশ ও কাগজ কেটে বিশেষ কারুকাজে রাসের মণ্ডপ তৈরি করা হয়েছে। মণ্ডপের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে বসে রাসধারী বা রাসের গুরু, সূত্রধারীরা এবং বাদকরা। পাশাপাশি তিনটি মণ্ডপে আনুমানকি প্রায় ২০০ জন কিংবা ততোধিক সংখ্যক তরুণী এ রাসলীলায় অংশ নিয়ে থাকে। রাসের সাধারণ ক্রম হচ্ছে- সূত্রধারী কর্তৃক রাগালাপ ও বন্দনা, বৃন্দার কৃষ্ণ আবাহন, কৃষ্ণ অভিসার, রাধা ও সখীদের অভিসার, রাধা ও কৃষ্ণের সাক্ষাৎ ও মান-অভিমান, ভঙ্গীপারেং, রাধার কৃষ্ণ-সর্মপণ, যুগলরূপ প্রার্থনা এবং আরতি ইত্যাদি।

মহারাসলীলা সেবা সংঘের সাধারণ সম্পাদক শ্যাম সিংহ জানান, মাধবপুর জোড়ামন্ডপে রাসোৎসব সিলেট বিভাগের মধ্যে ব্যতিক্রমী আয়োজন। এখানে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের আগমন ঘটে। বর্ণময় শিল্প সমৃদ্ধ বিশ্বনন্দিত মণিপুরী সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী রাস উৎসবে সবার মহামিলন ঘটে। মণিপুরি ললিতকলা একাডেমির গবেষণা কর্মকর্তা প্রভাস সিংহ জানান, এখানে সব ধরনের সুবিধা বিদ্যমান থাকায় এটি উৎসবে রূপ নিয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে উৎসবে যোগ দিতে হাজার হাজার ভক্ত অনুরাগী এখানে এসেছেন।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৭৬৯ খ্রস্টিাব্দে রাজা ভাগ্যচন্দ্র সিংহের আয়োজনে মণিপুরিরা প্রথম রাসলীলা পালন করেন। সেসময় মণিপুরি রাজা গৌড়ীয় ববষ্ণব ধর্মমতে মোহাবষ্টি রাজা স্বপ্নাদষ্টি হয়ে কন্যা লাইরোবিকে রাধার ভূমিকায় অবতীর্ণ করে রাস অনুষ্ঠানটির আয়োজন করেছিলেনে। মৈথিলি ও ব্রজবুলি ভাষার বিভিন্ন পদের মণিপুরি সঙ্গীতের নিজস্ব গায়কী ও মুদ্রা-পদবিক্ষেপে জটিল এবং ধ্রুপদি ধারার এই গীতিনৃত্যধারায় তা পালন করা হয়েছিল। মণিপুরিদের আদিভূমি ভারতের মণিপুরি থেকে এই রাস উপমহাদেশে তথা সমগ্র বিশ্বের নৃত্যকলার মধ্যে একটি বিশেষ স্থান করে দিয়েছে। যদিও সেটি একটি ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, কন্তিু তার নৃত্যশৈলী বরাবর সব ধর্ম ও জাতের মানুষকে আর্কষণ করেছে।

সাদা কাগজের নকশায় নিপুন কারু কাজে সজ্জিত করা হয় মন্ডপগুলো। রাসোৎসব উপলক্ষে শুক্রবার মহারাত্রির পরশ পাওয়ার জন্য হাজার হাজার মানুষের মিলনতীর্থ পরিনত হয় মাধবপুর জোড়া মন্ডপ আর আদমপুরের মন্ডপগুলো। মন্ডপে মণিপুরি শিশু নৃত্যশিল্পীদের সুনিপুন নৃত্যাভিনয় রাতভর মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখবে ভক্ত ও দর্শনার্থীদের। মণিপুরি সম্প্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকেরাও মেতে উঠে একদিনের এই আনন্দে।
 

এমএসি/আরএইচ