ঈদের আমেজ নেই বানভাসিদের

শুক্রবার ৮ জুলাই ২০২২ ১৯:০১


:: তিমির বনিক, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি ::
ঘর মেরামতে দিন চলে যাচ্ছে এখনো অনেকের ঘর ঘিরে আছে বন্যার পানি। বন্যার্ত অনেকের মনেই ঈদের আমেজ নেই। গতকাল হাকালুকি তীরবর্তী মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার বরমচালের লামা মাধবপুর গ্ৰামে ও দূরভিসন্ধি জীবন যাপন করছে।
রীতিমতো খরতাপে পুড়ছে সিলেট। এটা খানিকটা আশীর্বাদের মতো হয়ে এসেছে সিলেটের বন্যাকবলিত উপজেলাগুলোতে। নদীর পানি কমার পাশাপাশি বৃষ্টি না হওয়ায় পরিস্থিতির একটু একটু করে উন্নতি হচ্ছে। সুনামগঞ্জেও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘর মেরামত করতেই মানুষের সময় চলে যাচ্ছে। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ফিরেই মানুষ ব্যস্ত হয়ে পড়ছে ঘরকে বসবাসের উপযোগী করে গড়ে তুলতে। ‌তবে বন্যার কারণে আয়-রোজগার হারিয়ে বিপর্যয়ের মুখে থাকা মানুষকে মানবেতর জীবন-যাপন কাটাতে হচ্ছে। অনেকের বাড়িঘর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ায় তারা আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ফিরতে পারছে না। কেউ কেউ ঘরে ফিরলেও নাওয়া-খাওয়ার ঠিক নেই। অভাব-অনটনে তারা খাবার জোগাড় করতে পারছে না। মানবেতর জীবনযাপন করছে। মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় এখনো অনেক মানুষ পানিবন্দি। তারা সুপেয় পানি ও খাবার সংকটে দিনাতিপাত নির্বাহ করছে।
বন্যার পানি কমতে থাকায় সিলেটের বেশির ভাগ উপজেলার আশ্রয়কেন্দ্র থেকে মানুষ বাড়ি ফিরেছে। ঈদ কাছে চলে আসায় অনেকের মধ্যে বাড়ি ফেরার তাগাদা কাজ করছে। যাদের বাড়িঘর বন্যায় ভেসে গেছে, আশ্রয় নেওয়ার জায়গা নেই, তারা ছাড়া বাকিরা বাড়ি ফিরে গেছে। সিলেটের সবচেয়ে বেশি বন্যাকবলিত কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার নিম্নাঞ্চলের পানিও কমছে। অনেক জায়গায় বন্যার পানি সরে যাওয়ায় এসব এলাকার মানুষ নতুন করে জীবনসংগ্রামে নেমেছে।
গতকাল দুপুর থেকে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে, বাড়ি ফেরা মানুষের দিনের বড় অংশ কাটছে বাড়িঘর মেরামতে। শ্রমিক ডেকে কাজ করানোর সামর্থ্য যাদের নেই তারা নিজেরা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঘরকে বসবাসের উপযুক্ত করতে শ্রম দিচ্ছে। ইসলামপুর ইউনিয়নের উরামারা গ্রামের হাফিজ উদ্দিন প্রতিবেদক'কে বলেন, ‘আমাদের এই এলাকাটা তুলনামূলক নিচু। তাই এখানকার বাসিন্দারা চার-পাঁচ দিন ধরে ফিরছে। সবার ঘরবাড়ি কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন তারা ঘরবাড়ি মেরামত করেই দিন পার করছে।’
কোম্পানীগঞ্জের মতো জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, বিশ্বনাথ ও গোয়াইনঘাট উপজেলায়ও বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত থাকায় এখানে বাড়ি ফিরেছে আশ্রয়কেন্দ্রের মানুষজন। তারা ঘর গোছানোর পাশাপাশি খাবার জোগাড়ের সংগ্রামে দিন পার করছে। তবে ওসমানীনগর, বালাগঞ্জ, বিয়ানীবাজারের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও তা খুব ধীরে হচ্ছে। এসব এলাকার যারা এখনো আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছে তারা পরিস্থিতি দেখে পরে বাড়ি ফিরবে।
গোয়াইনঘাট উপজেলার ডৌবাড়ি ইউপির রশিদ আহমদ বলেন, ‘বেশির ভাগ মানুষই বাড়িঘরে ফিরেছে। নিম্নাঞ্চলের অনেকে এখনো রয়েছে। তবে তারা ঈদের আগেই বাড়ি ফিরতে চায়। আগামী দুই দিন বৃষ্টি না হলে নিম্নাঞ্চলগুলোর পানি আরো অনেক নেমে যাবে মনে হচ্ছে।’
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘বন্যায় জেলার প্রতিটি গ্রামেই অনেক মানুষের বসতঘর ভেঙে গেছে। আমরা প্রাথমিকভাবে সরেজমিনে গিয়ে যারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের তালিকা করে ১০ হাজার টাকা করে সহায়তা দিচ্ছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বিপুল। বন্যার পানি নেমে গেলে পূর্ণাঙ্গ ক্ষয়ক্ষতির চিত্র আমরা পাব।’
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘সুনামগঞ্জের কাঁচা ঘরবাড়ির যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ হওয়ার নয়। আমি গণপূর্ত বিভাগকে কাঁচা ঘরবাড়ির মালিকদের পিলার ও মেঝে পাকা করে দেওয়া যায় এমন প্রকল্প গ্রহণের জন্য বলেছি। তবে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ যাতে ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত না হয় আমরা নানাভাবে সরকারি-বেসরকারিভাবে সহযোগিতা করছি।’
সরেজমিনে গতকাল ও আজ বন ও পরিবেশমন্ত্রী শাহাব উদ্দিন বড়লেখা ও কুলাউড়ার বরমচাল, ভূকশিমইল, ভাটেরা, জয়চণ্ডী ইউনিয়নের বন্যাদুর্গত এলাকায় যায়, হাকালুকি তীরবর্তী এলাকাসহ কুলাউড়া উপজেলার প্রায় ৭০টির বেশি গ্রাম ও পৌর এলাকার বেশির ভাগ জায়গা প্লাবিত হয়েছে। মন্ত্রী ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মাঝে ঈদ সামগ্রী সহ ত্রান বিতরণ করেন। ২০ দিন পেরিয়ে গেলেও এখনো বন্যার পানির নিচে ওই সব এলাকার বেশির ভাগ বাড়ি, বাজার, মসজিদ, মন্দির, ঈদগাহ মাঠ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও রাস্তাঘাট। পানি খুবই ধীরগতিতে কমছে। অনেকের ঘরের ভেতর থেকে পানি নেমে যাওয়ায় বাড়ি ফিরে দুর্ভোগে পড়েছে। বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্যসংকটে পড়েছে। চুলা, বিছানাপত্র পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে অনেকের। দীর্ঘদিন পানি ও ঢেউয়ে অনেক কাঁচা বসতঘর নষ্ট হয়ে গেছে। পানিবাহিত রোগসহ বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে।
বরমচাল ইউনিয়নের লামা মাধবপুর গ্রামের বাসিন্দা আছিবুন বেগম (৬২) বলেন, ‘রাইত অইলে ঘুম লাগে না হাফিকুপির (সাপ) ও পানির ঢেউয়ের ভয়ে। পানি এইবার খুব আস্তে কমের (ধীরে কমছে)। আকাশ মেঘলা অইলে আরো ডর করে। বৃষ্টিতে যদি আবারও পানি বাড়ে।’
ভূকশিমইল ইউনিয়নের জাবদা গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর রহিম বলেন, ‘আমার ঘর থেকে এখনো পানি নামেনি। আশ্রয়কেন্দ্রে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে আছি। পানি যেন আটকে আছে, কমছেই না। ঘরের টিনের বেড়া হেলে গেছে। কাজ নেই, তাই আয়-রোজগারও নেই। অভাবে আছি, ঘর কিভাবে সংস্কার করব। বন্যার পানি চলে যাবে, কিন্তু পরিবারের থাকা-খাওয়া কিভাবে চালাব—এই দুশ্চিন্তায় আছি।’ একই ইউনিয়নের বাসিন্দা নূরজাহান বেগম বলেন, ‘১৮ দিন ধরে আশ্রয়কেন্দ্রে ছেলে, ছেলের বউ ও নাতি-নাতনিদের নিয়ে আছি। পানি কমলে বাড়িতে ফিরব। ছেলে শ্রমিকের কাজ করে। এই বন্যায় আমাদের ঘরের অনেক ক্ষতি হয়েছে।’
কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এ টি এম ফরহাদ চৌধুরী বলেন, ‘কুলাউড়ায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরির কাজ করছি। জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান স্যারের নির্দেশে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে বন্যা-পরবর্তী সময়ে পুনর্বাসনে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশ দেওয়া আছে বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের খোঁজখবর নিতে। আমরাও খোঁজ রাখছি। ত্রাণের সঙ্গে শুকনা খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও খাবার স্যালাইন প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্রসহ পানিবন্দি মানুষকে প্রতিদিন সরবরাহ করা হচ্ছে।

এমএসি/আরএইচ