এমবিবিএস পাস না করেও তারা চিকিৎসক, রংপুরে তাদের ছড়াছড়ি

শনিবার ২৮ অক্টোবর ২০২৩ ১৪:০৮


:: রংপুর প্রতিনিধি ::
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) অ্যাক্টের ২৯ (১) অনুযায়ী, নূন্যতম এমবিবিএস বা বিডিএস ডিগ্রি ছাড়া কেউ নামের আগে ডাক্তার পদবি ব্যবহার করতে পারবেন না। এ ছাড়া অ্যাক্টের ১৮ (১) ধারা অনুযায়ী, বৈধ কোনো ডাক্তার ছাড়া অন্য কেউ ওষুধ ব্যবস্থাপত্রে দিলে সে জন্য দুই বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে। অথচ এ আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দিনের পর দিন রংপুর সিটি কর্পোরেশনের ৩৩টি ওয়ার্ড ও জেলার ৮ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পল্লী চিকিৎসকরা নিজেদের ডাক্তার পরিচয় দিয়ে চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। এতে সঠিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষ। প্রশাসনের নাকের ডগায় বসে অনুমোদন ছাড়াই ফার্মেসির ব্যবসা করায় মোটা অংকের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। অভিযোগ না থাকা আর আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে অসহায় স্বাস্থ্য বিভাগ।
স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, যারা নিজেদের গ্রাম ও পল্লী ডাক্তার দাবি করছেন, তারা 'ভুয়া'। তাদের 'ডাক্তার' পদবি ব্যবহার ও চিকিৎসা দেওয়ার এখতিয়ার নেই। তাদের অপচিকিৎসার কারণে গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে টানাটানি হচ্ছে।
জানা যায়, আরএমপি, ডিএমএফ ও এলএমএএফ কোর্স করে নামের আগে ‘ডাক্তার’ লিখে রোগী দেখলেও এই পল্লী চিকিৎসকদের রোগী দেখার আইনগত অনুমোদন বা যোগ্যতা কোনোটাই নেই। এই চিকিৎসকদের অনেকেই ন্যূনতম এসএসসিও পাস করেননি। সাধারণ রোগীদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরামর্শ প্রদান এবং জটিল-স্পর্শকাতর রোগীদের বিশেষায়িত সরকারি  হাসপাতাল বা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কাছে প্রেরণের নিয়ম। অথচ তারা করছেন ঠিক এর উল্টো। চিকিৎসার নামে সাধারণ-জটিল সকল রোগের অপচিকিৎসা দিয়ে চলেছেন তারা। অসহায় রোগীদের তারা ব্যবহার করছেন ‘গিনিপিগের’ মতো।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রংপুরের বেশকিছু স্থানে ডাক্তার রূপধারী পল্লী চিকিৎসকদের দৌরাত্ম্য দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। রংপুর মহানগরের তুলনায় গ্রাম-গঞ্জে ও উপজেলা শহর এলাকায় এদের দৌরাত্ম্য তুলনামূলকভাবে বেশি। চটকদার সাইন বোর্ড টাঙ্গিয়ে নিজেদের নামের আগে ‘ডাক্তার’ উপাধি আর ‘ডিপ্লোমা, প্যারামেডিক, এলএমএএফ, ডিএইসএস, শিশু বিশেষজ্ঞ, কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার’ এর মতো নামে ভারী শব্দ লাগিয়ে দেদারছে অপচিকিৎসা-বাণিজ্য চালাচ্ছেন এরা। চেম্বার খুলে সাইনবোর্ডে নামের সঙ্গে ‘ডাক্তার’ উপাধি ও ডিগ্রির বহর যোগ করে এভাবেই প্রতারণা করে যাচ্ছেন।
সচেতন নাগরিকরা বলছেন, গ্রামাঞ্চলে চিকিৎসক সংকট থাকায় এবং মানুষের সচেতনতার অভাবকে পুঁজি করে বছরের পর রোগী দেখে যাচ্ছেন তারা। রোগমুক্তি তো দূরের কথা, এসব চিকিৎসকের ওষুধ খেয়ে নানান জটিলতায় ভুগছেন হাজারো রোগী। এছাড়া মাঝেমধ্যেই তাদের ভুল চিকিৎসার কারণে রোগী মারা যাওয়া মতো ঘটনাও ঘটছে। আবার অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে রোগকে আরো জটিল থেকে জটিলতর পর্যায়ে নিয়ে নিরাময়-অসম্ভব করে ফেলছেন।
রংপুরের বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, পল্লী চিকিৎসকের কাছে ভুল চিকিৎসার কারণে রোগীরা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন। রোগের প্রাথমিক অবস্থায় তারা উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দিচ্ছেন। সামান্য অসুখেও তারা উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের পরামর্শ দিচ্ছেন। অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে রোগীরা আক্রান্ত হচ্ছেন জটিল রোগে। ফলে রোগ নিরাময়ে সময় বেশি লাগছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, রংপুরের ৮টি উপজেলা ও মহানগরীর বক্তারপুর, হাজীরহাট, উত্তম, মনোহর, মাহিগঞ্জ, তাজহাট, হারাগাছ, পরশুরাম ও আশপাশের গ্রাম-গঞ্জে শত শত লাইসেন্সবিহীন ডাক্তার নামধারী চেম্বার খুলে জাঁকিয়ে বসেছেন।
রংপুর জেলার সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ ওয়াজেদ আলী এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘বিএমডিসি অ্যাক্ট অনুযায়ী এমবিবিএস পাসকৃত চিকিৎসক ও ডেন্টাল সার্জন ছাড়া কেউ তাদের নামের আগে ডা. (ডাক্তার) লিখতে পারে না। এটা যারা করছে তাদের চিকিৎসা প্রদানের ক্ষেত্র যাচাই করে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কারণ এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আমরা বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখবো।
রংপুরের জেলা প্রশাসক মেহাম্মদ মোবাশ্বের হোসেনের সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি বলেন, এ ধরনের অপচিকিৎসকদের বিষয়ে তারা অবগত রয়েছেন। কিন্তু জেলা প্রশাসনকে প্রতিদিন অনেকগুলো সরকারি কাজ সম্পাদন করতে হয়। এর বাইরে বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা রোজই মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছেন’। এই বিষয়টি নিয়েও তারা এর আগে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেছেন। তবে ‘জনস্বাস্থ্য’র বিষয়টি সবার আগে। তাই শিগগিরই এ ব্যাপারে বেশি বেশি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে।

এমএসি/আরএইচ